সম্পাদকীয়

পুলিশের ওপর হামলা-রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য অশনিসংকেত

সম্প্রতি রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর ও প্রত্যন্ত এলাকায় পুলিশ সদস্যদের ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনা এক গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই হামলায় কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই আহত বা নিহত হচ্ছেন না, বরং পুরো বাহিনীর মধ্যে দেখা দিচ্ছে ভয়, অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপ। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরাই যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তখন সেটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক ভয়াবহ অশনিসংকেত। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই পুলিশের ওপর হামলা ও হেনস্তার ঘটনায় ৪৬২টি মামলা হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। কখনো সন্ত্রাসী বা রাজনৈতিক সহিংসতায় যুক্ত গোষ্ঠীর হাতে, কখনো ডাকাত বা ছিনতাইচক্রের দ্বারা, এমনকি ক্ষুব্ধ জনতার ‘মব’ হামলাতেও পুলিশ আক্রান্ত হচ্ছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব ঘটনার অনেক ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে অপরাধপ্রবণতা আরও সাহসী হয়ে উঠছে। পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে এর প্রভাব গভীর। দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হওয়ার ভয়, সামাজিক অপমান ও ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ অনেক সদস্যের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। মাঠপর্যায়ের অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালনেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না-এ বাস্তবতা যে কতটা বিপজ্জনক, তা অনুধাবন করা জরুরি। কারণ, পুলিশ কেবল অপরাধ দমনকারী বাহিনী নয়; রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ও জননিরাপত্তার ভিত্তি। অপরাধ বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলছেন-এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে কৌশলগত পুনর্বিন্যাস ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার মাধ্যমে। মাঠ পর্যায়ে বডিক্যাম, আধুনিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, দ্রুত ব্যাকআপ টিম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে হামলার ঘটনায় দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত, দোষীদের শাস্তি এবং ঘটনাগুলোর বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা জরুরি। ন্যায়বিচারের দৃশ্যমানতা না থাকলে, অপরাধীরা উৎসাহ পাবে-আর সাধারণ মানুষ পুলিশের প্রতি আস্থা হারাবে। অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রশাসনিক চাপ ও সামাজিক বিভাজনের সময়ও পুলিশই ছিল রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয়। সেই বাহিনী যদি এখন ক্রমাগত আঘাতের শিকার হয়, তবে তা শুধু আইনশৃঙ্খলার নয়-রাষ্ট্রের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম-সবারই দায়িত্ব পুলিশকে পেশাগত মর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখা। মনে রাখতে হবে, দুর্বল পুলিশ মানে দুর্বল রাষ্ট্র। তাই পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা আর বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু-যা রুখতে হবে এখনই।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button