সম্পাদকীয়

টেকসই খাদ্য নিরাপত্তায় বিকেন্দ্রীকৃত কৃষি গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের কৃষি আজ এক যুগান্তকারী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি-আবাদযোগ্য জমি ক্রমেই কমছে, জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত, আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেন প্রতিনিয়ত ঘনীভূত হচ্ছে। একদিকে খরা, অন্যদিকে বন্যা, লবণাক্ততা ও তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক বৈরিতা কৃষকদের জীবন ও দেশের খাদ্যনিরাপত্তাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলছে। এই বাস্তবতায় কৃষি গবেষণায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানভিত্তিক পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) যে উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন আঞ্চলিক কার্যালয় ও স্যাটেলাইট অফিস স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ। কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুরে স্থাপিতব্য নতুন কার্যালয়গুলো শুধু গবেষণার বিকেন্দ্রীকরণ নয়, বরং অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার সমাধানে লক্ষ্যভিত্তিক কৃষি উদ্ভাবনের এক নতুন যুগের সূচনা করবে। বাংলাদেশের কৃষি ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। দেশের উত্তরাঞ্চলের শৈত্যপ্রবাহ ও খরা যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড় অন্য এক বাস্তবতা তৈরি করে। ফলে একক ধানের জাত দিয়ে সারাদেশের খাদ্যচাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে ব্রির উদ্যোগ স্থানীয় প্রেক্ষাপটে উপযোগী সহনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পাহাড়ি অঞ্চলে জুমচাষের নি¤œফলন সমস্যা মোকাবেলায় খাগড়াছড়ি কার্যালয়, লবণাক্ত উপকূলীয় অঞ্চলে কক্সবাজার কেন্দ্র বা হাওরাঞ্চলে সুনামগঞ্জের উদ্যোগ-প্রতিটি উদাহরণই দেখায়, গবেষণা এখন মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। একইভাবে, দিনাজপুরে প্রিমিয়াম মানের সুগন্ধি ধান উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা দেশের কৃষিপণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। ব্রির পূর্ববর্তী উদ্ভাবনগুলো-যেমন ব্রি ধান ২৮, ২৯, ৪৭, ৭৬ বা ৭৭-প্রমাণ করেছে যে, গবেষণা ও প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সম্ভব। নতুন আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো চালু হলে কৃষকরা আরো দ্রুত প্রযুক্তিসেবা পাবেন, স্থানীয় পরিবেশ অনুযায়ী জাত নির্বাচন সহজ হবে এবং টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তবে এই উদ্যোগকে সফল করতে হবে সমন্বিত নীতিগত সহায়তা, পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও দক্ষ জনবল নিশ্চিতের মাধ্যমে। একই সঙ্গে গবেষণার ফল যেন মাঠপর্যায়ে দ্রুত পৌঁছায়, সেদিকে নজর দিতে হবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা কেবল উৎপাদনের ওপর নয়, বরং অভিযোজন ও উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করছে। ব্রির বিকেন্দ্রীকৃত গবেষণা উদ্যোগ সেই অভিযোজনেরই বাস্তব প্রতিফলন-যা ভবিষ্যতের কৃষি, পুষ্টি ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button