চট্টগ্রাম ইপিজেডে অস্থিরতা-শিল্প ও মানবিক সংকটের সতর্কবার্তা

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)-দেশের শিল্পোন্নয়নের এক ঐতিহাসিক প্রতীক। এই অঞ্চল একসময় ছিল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এবং লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবিকার ভরসা। অথচ সেই সিইপিজেড এখন এক গভীর মানবিক ও শিল্প বিপর্যয়ের মুখে। একদিকে ভয়াবহ অগ্নিকা-, অন্যদিকে শ্রমিক অসন্তোষ ও সংঘর্ষের ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যতম রপ্তানি কেন্দ্রটি আজ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত। মাত্র গত দশ মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৬টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক। সর্বশেষ প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের সাতটি কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়েছেন ৩৫ হাজার শ্রমিক-যাদের অনেকেই একমাত্র উপার্জনকারী পরিবারের সদস্য। কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে হাজারো পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে অচিন্তনীয় দুর্দশা ও হতাশা। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এক গভীর মানবিক সংকটও বটে। এর আগে সিইপিজেডে অ্যাডামস ক্যাপস ও জিহং মেডিক্যাল প্রোডাক্টে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে গেছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ভবনের নিরাপত্তা কাঠামোর ঘাটতি ও নকশা লঙ্ঘনের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে। অথচ এসব দুর্বলতা বছরের পর বছর ধরে চিহ্নিত হলেও কার্যকর তদারকি হয়নি-ফলেই ঘটছে একই ধরনের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। চট্টগ্রাম শিল্পাঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়; এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ এবং শিল্প শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন। যেখানে একদিকে শ্রমিকরা তাদের অধিকার ও নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষুব্ধ, অন্যদিকে মালিকপক্ষ উৎপাদন বিঘিœত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত-সেই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। ইতিমধ্যে বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে চট্টগ্রামে প্রায় ২৬৯টি কারখানায় তালা পড়েছে। এটি দেশের পোশাকশিল্পের জন্য এক অশুভ সংকেত। সরকারের উচিত এখনই এই পরিস্থিতিকে কেবল শ্রমিক অসন্তোষ নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সংকট হিসেবে দেখা। শ্রমিক-মালিক সংলাপের পাশাপাশি সিইপিজেডে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পূর্ণ সংস্কার, অগ্নিনিরাপত্তা মানদ-ে কঠোর প্রয়োগ, এবং শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তিতে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন ও পুনঃকর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে-যাতে তারা হতাশা ও দারিদ্র্যের গভীরে তলিয়ে না যায়। চার দশকের ইতিহাসে সিইপিজেড বাংলাদেশের শিল্পায়নের অন্যতম সাফল্যের প্রতীক ছিল। সেই প্রতীকে যদি আজ অনিশ্চয়তা ও আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা কেবল একটি অঞ্চলের নয়-পুরো দেশের রপ্তানি সম্ভাবনা ও শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখনই প্রয়োজন দায়িত্বশীল নেতৃত্ব, কঠোর তদারকি এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি-যাতে চট্টগ্রামের এই সংকট থেকে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি।
