অগ্নিকা-ের বিচারহীনতা-ন্যায়বিচারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়

বাংলাদেশে অগ্নিকা- যেন এক নিত্যদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। বড় ধরনের অগ্নিকা- ঘটলেই মুহূর্তে জাতি শোক ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে-শুরু হয় তদন্ত, গঠিত হয় একাধিক কমিটি, ঘোষণা আসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সামান্য আর্থিক সহায়তার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু থেমে যায়। তদন্ত ঝুলে থাকে, মামলা বছর বছর পেরোয়, আর অভিযুক্তরা জামিনে মুক্ত থেকে নির্বিঘœ জীবনযাপন করেন। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠছে। গত এক দশকের অগ্নিকা-ের ঘটনাগুলো এর স্পষ্ট প্রমাণ। ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকা-ে ১১১ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন-এখনো বিচার শেষ হয়নি। ২০১৯ সালের চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকা-ে ৭১ জনের মৃত্যু, বনানীর এফআর টাওয়ারে ২৭ জনের প্রাণহানি, কিংবা ২০২৪ সালের বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ৪৬ জনের মৃত্যুর মতো ভয়াবহ ঘটনার বিচারও বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। প্রতিটি মামলাই তদন্ত বা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে, আর সব আসামি জামিনে মুক্ত। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাই হতাশ ও নিরাশ-তারা জানে, বিচার পেতে হয়তো একটি জীবনই যথেষ্ট নয়। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মামলার দীর্ঘসূত্রতার পেছনে রয়েছে দুর্বল তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে অবহেলা, প্রশাসনিক গাফিলতি এবং প্রভাবশালী আসামিদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব। অনেক সময় অগ্নিকা-কে “দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা”হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেন কেউ দায়ী নয়। অথচ বাস্তবতা হলো-বেশিরভাগ ঘটনাই নিরাপত্তাবিধি উপেক্ষা, অবৈধ নির্মাণ বা দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের কারণে ঘটে। অর্থাৎ, এগুলো দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত হত্যাকা-। বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি শুধু আইনি কাঠামোর দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে না, এটি নাগরিকের ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থাকেও ভেঙে দেয়। যখন দেখা যায়, প্রতিটি অগ্নিকা-ের পর একই দৃশ্য-কান্নার সাগর, তদন্ত কমিটি, তারপর নীরবতা-তখন নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ‘রাষ্ট্রের বিবেক কি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে?’ অগ্নিকা-ের মতো জননিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ঘটনায় দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, সাক্ষী হাজিরে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা, এবং সরকারি-বেসরকারি ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা যাচাইয়ে কঠোর তদারকি-এসব এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি প্রাণহানির পেছনে রয়েছে একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি গল্প। এই গল্পগুলো ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় থমকে আছে। রাষ্ট্র যদি এই বিচারহীনতার চক্র ভাঙতে না পারে, তবে আগুনে পুড়বে কেবল ভবন নয়-পুড়বে জনগণের আস্থা, পুড়বে ন্যায়বিচারের ভিত্তিও।
