সম্পাদকীয়

ভূমিকম্পের ভয়াল দুর্যোগ প্রতিহতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে

ভূমিকম্প অন্য সব দুর্যোগের তুলনায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তীব্রতা ও ঝুঁকি বহন করে। ভূমিকম্প অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত, সবচেয়ে দ্রুত এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মতো আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ কম থাকায় ভূমিকম্পের ক্ষতি প্রতিরোধ পুরোপুরি করা যায় না, কমানো যায়। যখন পায়ের তলার মাটিই হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে, তখন আমাদের অস্তিত্বের গভীরে এক আদিম ভয় জাগে। ভূমিকম্প-প্রকৃতির সেই রুষ্টতা, যা কোনো রকম আগাম সতর্কতা ছাড়াই আমাদের সাজানো জীবন মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। এটি কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি মানবসমাজের টিকে থাকার পথে এক চরম চ্যালেঞ্জ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ একটি সক্রিয় ভূমিকম্প বলয়ের মাঝে অবস্থিত। ভূতত্ত্ববিদদের সতর্কবার্তা হলো এই অঞ্চলের টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়া প্রতিনিয়ত শক্তি সঞ্চয় করছে, যা ভবিষ্যতে একটি বড় আকারের ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। এই ঝুঁকিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ঝুঁকি যখন দ্বারপ্রান্তে, তখন একমাত্র সচেতনতা ও প্রস্তুতিই পারে এর ভয়াবহতা কমাতে। ২১ নভেম্বর যে মাঝারি (৫.৭) মাত্রার ভূমিকম্পটি হয়ে গেল, তা যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে আসা এক জরুরি বার্তা। কম্পনটি হয়তো খুব তীব্র ছিল না, কিন্তু এই ঝাঁকুনিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমরা কতটা অরক্ষিত। এই কম্পনের ফলে পুরান ঢাকায় দুর্ভাগ্যবশত তিনজনের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু পুরোনো ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে ও দেয়াল ধসে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করে, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব হলেও এটি যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে এবং সামান্য ঝাঁকুনিতেই আমাদের দুর্বল অবকাঠামো গুরুতর সংকটে পড়তে পারে। আতঙ্ক ও ছোটাছুটির দৃশ্য প্রমাণ করে আমরা এখনও মানসিক এবং কাঠামোগতভাবে প্রস্তুত নই। আমাদের এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘যখন’ ভূমিকম্প হবে, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শুক্রবারের ভূমিকম্পে যে হতাহত হয়েছে, তা মূলত রেলিং ও দেয়াল ধসে, ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া ও আতঙ্কে ছোটাছুটি করার কারণেই। অর্থাৎ কম্পনের তীব্রতার চেয়ে প্রস্তুতির অভাবই মানুষের প্রাণ কেড়েছে বেশি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি মূলত মানবসৃষ্ট ভুলের ফল। গবেষকেরা বলছেন, নরসিংদী ও আশপাশের অঞ্চলটি সাবডাকশন জোন—বার্মা প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। এই অঞ্চলে শত শত বছর ধরে শক্তি জমছে, যে শক্তি প্রায় ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। শুক্রবারের ভূমিকম্প সেই শক্তির সামান্য অংশমাত্র। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—সামনে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে এবং আমাদের প্রস্তুতি একেবারেই অপ্রতুল। সচেতনতা এবং প্রস্তুতি কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং এটি বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত। প্রতিটি নাগরিকের উচিত ভয়কে শক্তিতে রূপান্তর করা, যেখানে কাঠামোগত সুরক্ষা আমাদের বর্ম এবং ব্যক্তিগত প্রস্তুতি আমাদের ঢাল। এই সচেতনতাই পারে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল পরিণামকে সহনীয় স্তরে নামিয়ে আনতে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button