রাজশাহীর আমবাগানে সংকট-অর্থনীতি ও প্রকৃতির জন্য সতর্কবার্তা

রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা-বাংলাদেশের আমচাষের প্রাণকেন্দ্র। দেশের মোট আমবাগানের দুই-তৃতীয়াংশ এই দুই উপজেলায় অবস্থান করায় এ অঞ্চল আমের রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। অথচ বর্তমানে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা এই ‘আমনগরী’র জন্য এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে থেকে জানা গেছে, গত দুই বছরে সরকারি হিসাবে ৭১৪ হেক্টর, আর স্থানীয়দের মতে প্রায় এক হাজার হেক্টর আমবাগান কেটে ফেলা হয়েছে। আমচাষ নির্ভর এই অঞ্চলে এমন দ্রুত ধস নামা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। চাষিরা অভিযোগ, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া তাদের প্রধান হতাশার কারণ। উৎপাদন ব্যয় বছরের পর বছর বাড়ছে-কীটনাশক, হরমোন, শ্রম, পরিবহন-সব কিছুর দাম বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রোগবালাইও বেড়েছে, ফলে স্প্রে দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ। অথচ বাজারে সর্বোচ্চ ৬০০-৮০০ টাকায় মণ বিক্রি করে উৎপাদন ব্যয়ই তুলতে পারছেন না তারা। যে চাষে লোকসান অনিবার্য, সেখানে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে-এটাই স্বাভাবিক। ফলে কেউ লিজ দিয়ে দিয়ে পেয়ারা-বরই-ড্রাগন চাষ শুরু করছেন, কেউ সম্পূর্ণ বাগান কেটে অন্য ফসল করছেন। এভাবে বিরাট একটি কৃষি অর্থনীতি ধীরে ধীরে নিজের ভিত্তি হারাচ্ছে। এই সংকটে আরেকটি বড় কারণ সংরক্ষণাগারের অভাব। দেড় হাজার কোটি টাকার বাজার থাকা সত্ত্বেও রাজশাহীতে একটি আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ নেই। মৌসুমের ব্যস্ত সময়ে সরকারি ছুটিতে ক্রেতা কমে গেলে প্রচুর পাকা আম নষ্ট হয়ে যায়। সংরক্ষণের সুবিধা থাকলে বাজার স্থিতিশীল রাখা যেত, চাষিরাও পেতেন ন্যায্যমূল্য। তদুপরি, রপ্তানিখাতেও পতন স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের বাজার হারিয়ে এখন সামান্য কিছু আম ইউরোপে যাচ্ছে-সেটিও ক্রমে কমছে। ঢাকাকেন্দ্রিক প্যাকিং হাউস, জটিল ল্যাব টেস্ট, পরিবহন বিলম্ব-সব মিলিয়ে রপ্তানিযোগ্য আম নষ্ট হয়ে ফেরত আসে। চাষিরা তাই রপ্তানিমুখী আমচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বাগানধ্বংসের পরিবেশগত ক্ষতিও অনিবার্য। পাখির আবাস হারানো, মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া, তাপমাত্রা বাড়া-এসব বিপদ এখন আর কল্পনার বিষয় নয়। একসময় আদালত নির্দেশে সংরক্ষিত হওয়া বাগানও আজ টিকে নেই। আমচাষের সঙ্গে যুক্ত বিপুল শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও পরিবহন খাতও এই সংকটে ক্ষতির মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় কৃষি বিভাগের দায় শুধুই ‘সচেতনতা বৃদ্ধি’ দিয়ে শেষ করা যায় না। রাজশাহীতে অবিলম্বে কোল্ড স্টোরেজ, আধুনিক প্যাকিং হাউস, রপ্তানি প্রটোকল সহজীকরণ এবং বৈজ্ঞানিক আমচাষে প্রণোদনা জরুরি। নির্বিচারে গাছ কাটার বিরুদ্ধে কঠোর তদারকি প্রয়োজন। একই সঙ্গে পুরোনো বাগান পুনর্জীবিত করা এবং চাষিদের জন্য লাভজনক বাজার কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। রাজশাহীর আম কেবল একটি কৃষিপণ্য নয়-এ অঞ্চলকার মানুষের অর্থনীতি, ঐতিহ্য ও পরিবেশের অংশ। আজ আমবাগান রক্ষা করা মানে একটি অঞ্চলকে ভবিষ্যতের বিপর্যয় থেকে বাঁচানো। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়; নইলে ‘আমের রাজধানী’ হয়তো নামেই থেকে যাবে, বাস্তবে আর নয়।
