সম্পাদকীয়

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দেশ

বাংলাদেশ বহু বছর ধরে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখালেও সম্প্রতি একের পর এক আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বন্ধ হয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করেছে। ইউএসএইডের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর এবার গ্লোবাল ফান্ডের অর্থায়নও ৩১ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ হতে যাচ্ছে-যা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে (এনটিপি) অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর সরাসরি ফল হিসেবে ৪৭৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি ঝুঁকিতে পড়েছে; ইতিমধ্যে ২,২০০ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। দেশের ৬৫০ কেন্দ্রের যক্ষ্মা শনাক্তকরণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এখন বাস্তব হুমকি। প্রতিবছর দেশে প্রায় তিন লাখ ৭৯ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন এবং ৪৪ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল উচ্চাভিলাষী হলেও বাস্তবসম্মত। কিন্তু চলমান সংকট সেই লক্ষ্য পূরণের পথকে বিপদসঙ্কুল করে তুলছে। বিশেষ করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার বাড়তি ঝুঁকি পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। ইতিমধ্যে ওষুধপ্রতিরোধী রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে শনাক্ত না হওয়া রোগীর সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। ওষুধ ও কিটের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসা, ক্রয় প্রক্রিয়ার ধীরগতি, এবং মাঠপর্যায়ে কর্মী সংকট-এই তিনটির সমন্বয়ে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সাধারণত ছয় মাস আগে ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করার কথা থাকলেও এই কাজে অবহেলা দেখা গেছে, যার ফলে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকারি অর্থায়নের ক্ষেত্রেও দীর্ঘ বিরতি তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের জুনে পুরোনো সেক্টর কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার পর নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) অনুমোদন আজও ঝুলে রয়েছে। তিন দশক ধরে পরিচালিত এই কর্মসূচিতে দেড় বছর ধরে নিয়মিত বরাদ্দ না থাকা নিঃসন্দেহে নীতিগত দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়ের ঘাটতি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কর্মসূচি অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হওয়ায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয় গড়ে ওঠেনি। গবেষণা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ফলে এখনো ১৭ শতাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছে-যা আন্তর্জাতিক মানদ-ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অথচ যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য রোগ। বিশ^জুড়ে যখন প্রতিরোধ ও চিকিৎসার সমন্বিত উদ্যোগ চলছে, তখন বাংলাদেশে অর্থায়ন, জনবল ও প্রশাসনিক দেরি মিলিয়ে একটি মৌলিক জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে থাকা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন-গ্লোবাল ফান্ডের বিকল্প অর্থায়ন নিশ্চিত করা, সরকারি বরাদ্দ পুনর্বহাল করা, ক্রয় প্রক্রিয়া দ্রুততর করা এবং মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম স্বাভাবিক করা। দেরি হলে এর মূল্য দিতে হবে হাজারো প্রাণ দিয়ে, এবং যক্ষ্মা নির্মূলের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা বহু বছর পিছিয়ে যাবে। একজন নাগরিক হিসেবে আমরা চাই সরকার, উন্নয়ন সহযোগী এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দ্রুত সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করুক-জনস্বাস্থ্যের এই সংকট আর বিলম্ব সহ্য করে না।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button