সম্পাদকীয়

শিল্প ও কর্মসংস্থানের অচলাবস্থা উত্তরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি

দেশে একদিকে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব শ্রমবাজারকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের আকাশছোঁয়া সুদের হার, কাঁচামাল ও জ্বালানির সংকট এবং দুর্বল অবকাঠামো শিল্পোদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। অনেক উদ্যোক্তা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এর ফলে উৎপাদন গতিতে লাগাম টানতে হচ্ছে, বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং বাজারে পণ্যের কাটতি না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা কঠিন সময় পার করছেন। চাকরির বাজারে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে। বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না। শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা আরও করুণ, কারণ কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার অভাবে তারা সার্টিফিকেট-নির্ভর হয়ে পড়ছেন, যা চাকরির বাজারে তাদের অযোগ্য করে তুলছে। এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে জ্বালানি ঘাটতি। শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও সারের জন্য দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা আশঙ্কা করছে, ২০২৬ সালে উৎপাদন আরও কমতে পারে। মার্কিন কোম্পানি শেভরনসহ সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমার পূর্বাভাস রয়েছে। সরকার ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিলেও অধিকাংশ কাজ শুরু হয়নি। ফলে অনিশ্চয়তা কাটছে না। বিদ্যমান শিল্প, বিশেষ করে টেক্সটাইল খাত মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। আগামী বছরের জন্য গ্যাস সরবরাহ এবং কোন খাতে কত বরাদ্দ হবে, সেই চূড়ান্ত পরিকল্পনাও এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাচনের পর একটি বিনিয়োগবান্ধব নীতির স্বচ্ছ রূপরেখা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ঋণের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা সহজে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারেন। তৃতীয়ত, জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি। নতুন কূপ খনন দ্রুত শেষ করতে হবে এবং এলএনজি আমদানির নিশ্চয়তাপত্র অবিলম্বে সরবরাহকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে কর্মমুখী ও আন্তর্জাতিক চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। সবশেষে, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, উচ্চ কর এবং দুর্বল অবকাঠামো-বিনিয়োগের এই সুনির্দিষ্ট বাধাগুলো অপসারণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের শিল্প ও কর্মসংস্থান খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগ স্থবিরতা ও জ্বালানি সংকট যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা থমকে যাবে এবং বেকারত্ব আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সরকার যদি সাহসী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়, তবে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব এবং দেশ আবারও শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তে পৌঁছতে পারবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button