সম্পাদকীয়

ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক: অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের নতুন জানালা, নাকি নীতিগত আরেক পরীক্ষা?

ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক উদ্যোগকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে-যা দেশের তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। সিএমএসএমই খাত দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩২ শতাংশ জোগান দেয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র। অথচ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা, জামানতের বাধ্যবাধকতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব বহু উদ্যোক্তাকে পথরোধ করেছে। অপরদিকে এনজিও-ভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণে সুদের হার এত বেশি যে অনেক উদ্যোক্তা প্রকৃতপক্ষে লাভের পরিবর্তে ঋণচক্রে আটকা পড়েন। এ বাস্তবতা থেকেই বিশেষায়িত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের দাবি দীর্ঘদিন ধরে উঠছিল। সরকারের নতুন উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য-জামানতবিহীন ও কম সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদান, ব্যবসায়িক সহায়তা এবং নতুন উদ্ভাবন ও কর্মসংস্থানকে উৎসাহ দেওয়া। খসড়া অধ্যাদেশে অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যেখানে প্রারম্ভিক পরিশোধিত মূলধন হবে ১০০ কোটি। বিশেষ দিক হলো-ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারীরাই ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার হতে পারবেন, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও গণমুখী করে তুলতে পারে। পরিচালনা বোর্ডেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। এই কাঠামো উন্নয়ন ভাবনার নতুন চিত্র তুলে ধরলেও প্রশ্নও কম নয়। ক্ষুদ্রঋণ খাত আজ অবধি যেসব সমস্যায় জর্জরিত-স্বচ্ছতার ঘাটতি, অতিরিক্ত সুদ, তদারকির দুর্বলতা, অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করলে নতুন ব্যাংকও পুরোনো অসুস্থ চক্রে ঢ়ুকে যেতে পারে। খসড়ায় লাইসেন্স প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এমসিআরএ-র অধীনে পৃথক বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা নজরদারিতে কিছুটা শক্তি যোগ করতে পারে। তবে এর বাস্তব প্রয়োগই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-ঋণের পাশাপাশি কারিগরি সহায়তা, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, বিপণন, বীমা ও দক্ষতা উন্নয়ন। শুধু অর্থায়ন নয়, একটি উদ্যোগকে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা দেওয়া উন্নয়ন-নীতির পরিপক্বতা দেখায়। এতে নবীন উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-সবার জন্যই নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে ব্যাংককে সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত লভ্যাংশ সীমিত করতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে কিছু বাধা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এখানে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি-অতিরিক্ত মুনাফার কাঠামো নয়, আবার বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার মতো কঠোর সীমাবদ্ধতাও নয়। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রশংসনীয়; তবে এটি যেন কাগজে-কলমে আটকে না থাকে। কার্যকর নজরদারি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছ ঋণনীতি, ডিজিটাল ট্র্যাকিং এবং দুর্নীতি-নিয়ন্ত্রণ-সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে এ ব্যাংক শুধু ঋণই দেবে না; দেবে উদ্যোক্তা হওয়ার আশা। আর কর্মসংস্থানের নতুন দরজা খুলে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাস্তব অবদান রাখতে পারবে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button