মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের শোষণ-রাষ্ট্রের এখনই কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের শোষণ, দুর্ব্যবহার ও প্রতারণা নিয়ে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক উদ্বেগ এক গভীর মানবিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। আট লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক সেখানে বৈধভাবে কাজ করলেও তাদের বড় অংশই পাসপোর্ট বাজেয়াপ্তকরণ, ভুয়া নিয়োগপত্র, নির্ধারিত কাজ না পাওয়া, ঋণের ফাঁদে আটকা পড়া এবং আইনগত অনিশ্চয়তার ভেতর মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে যে পদ্ধতিগত নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে, তা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; এটি দুই দেশের শ্রমবাজার সহযোগিতার নৈতিক কাঠামোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, অনেক শ্রমিককে সরকারি নির্ধারিত হারের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ফি পরিশোধ করতে হয়েছে-তবুও তারা প্রতিশ্রুত কাজ বা বেতন পাননি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি দুর্বল হওয়ায় দালালচক্র ও অসাধু নিয়োগকারীরা সহজে শ্রমিকদের প্রতারণার জালে ফেলছে। মালয়েশিয়ার কঠোর অভিবাসী আইন অনুযায়ী নথিপত্র না থাকলে গ্রেপ্তার, আটক বা বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকি বিরাজমান। বর্তমানে দেশটির আটককেন্দ্রে প্রায় ১৮ হাজার অভিবাসী, শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী আটক-যাদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যাও কম নয়। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানি খাতের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা। যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি নিষেধাজ্ঞা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসন্ন ‘ফোর্সড লেবার রেগুলেশন’-এসবই শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থানকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ‘জবরদস্তিমূলক শ্রম’-এর অভিযোগ বাড়লে কেবল শ্রমিকই নয়, দেশের রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন বাস্তবতায় প্রয়োজন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার যৌথ ও কঠোর উদ্যোগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে-অতিরিক্ত ফি আদায়, ভুয়া নিয়োগপত্র, দালালচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে নিয়োগকারী ও প্রেরণকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বৈধ শ্রমিকদের সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা জোরদার করতে হবে। বিদেশে পাঠানো প্রতিটি শ্রমিককে কার্যকর হেল্পডেস্ক, আইনগত সহায়তা ও জরুরি যোগাযোগ কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী নিয়োগ ব্যয় তাদের ক্রয় মানদ-ে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকদের ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ চাপিয়ে দিতে পারবে না। শ্রমিকদের অধিকাররক্ষায় বৈশি^ক বাণিজ্যচক্রের এই দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য স্পষ্ট-শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ না হলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বাড়বে, আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হাজারো শ্রমিক ও তাদের পরিবার। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশের সরকারের উচিত অবিলম্বে তদন্ত, দায় নিরূপণ এবং পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন। বিদেশে শ্রম রপ্তানি বাংলাদেশের শক্তি; কিন্তু সেই শ্রম যদি শোষণ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওপরে দাঁড়ায়, তবে এটি টেকসই নয়। এখনই সময় শ্রমিকদের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার।
