সীমান্তে অব্যাহত রক্তপাত: মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজন দৃঢ় উদ্যোগ

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বহু বছর ধরেই উত্তেজনা, উদ্বেগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক আইন বলছে-যুদ্ধাবস্থা ছাড়া সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী গুলি চালানো যাবে না। কিন্তু ঠাকুরগাঁও সীমান্তের বাস্তবতার সঙ্গে এই নীতি বেদনাদায়কভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। গত ১২ বছরে শুধু এই অঞ্চলে বিএসএফের গুলিতে অন্তত ২৪ বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু স্থানীয় মানুষের অভিযোগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য এ সত্যকে তুলে ধরে। এই মৃত্যুগুলোর প্রেক্ষাপট বহুমাত্রিক-কেউ আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন, কেউ কৃষিকাজ করছিলেন, কেউবা নদী বা চর এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন। বহু ক্ষেত্রে নিহতদের ‘চোরাকারবারী’ আখ্যা দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু পরিবারের বক্তব্য, বাস্তবতা সব সময়ই এত সরল নয়। প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি পরিবারের দীর্ঘশ^াস, ভবিষ্যৎ হারানোর বেদনা এবং ন্যায়বিচারের দীর্ঘ অনিশ্চয়তা। বিজিবির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে-সীমান্ত অতিক্রমের ঝুঁকি কমলেই প্রাণহানির সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। তারা নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, স্থানীয় ইমাম-শিক্ষক থেকে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সবাইকে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের বক্তব্য, মানুষের সহযোগিতা থাকলে সীমান্ত আরও শান্ত হবে। নিঃসন্দেহে আইন মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য; তবে একই সঙ্গে এটি সত্য যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ- পালন নিশ্চিত করার দায়ও সমানভাবে দুই দেশের। স্থানীয় মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি-সীমান্তে কাঠামোগত নিরাপত্তা জোরদার করা হোক, যাতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি বহু বিশ্লেষক মনে করছেন, পররাষ্ট্রনীতিতে দৃঢ়তা না থাকলে সীমান্ত সমস্যা কখনোই স্থায়ী সমাধানের দিকে যাবে না। ফেনী বা ফেলানীর মতো ঘটনার বিচারবঞ্চিত পরিবারগুলোর যন্ত্রণা আজও জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনগত সহায়তার প্রসঙ্গে লিগ্যাল এইড অফিসের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ-প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার আছে। সীমান্তে নিহতদের পরিবার যদি বিচার চায়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে তাদের পাশে দাঁড়ানোই কর্তব্য। এখনো কোনো পরিবার আইনি পদক্ষেপ নিতে সামনে না এলেও সুযোগটি যে তাদের জন্য খোলা রয়েছে, তা স্পষ্টভাবে জানানো প্রয়োজন। নিরাপত্তা, মানবাধিকার এবং দুই দেশের সম্পর্ক-এই তিন বিষয়ের সমন্বয় ঘটিয়েই সীমান্ত পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তা না হলে সীমান্তের বুকে এই রক্তপাত চলতেই থাকবে, আর শোকের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। সীমান্ত শান্ত হোক-এটি শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়; এটি দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সৌহার্দ্যরে পূর্বশর্ত।
