মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও আধিপত্যবাদ

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন, পিএসসি
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের গৌরবময় পরিণতি; একটি জাতির আত্মত্যাগ, দৃঢ়তা ও অদম্য মনোবলের ফল। প্রায় শূন্য সামরিক সক্ষমতা নিয়েই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বিশে^র অন্যতম শক্তিশালী পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধের গতি পুরোপুরি বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসছিল। দেশের মাটি ও মানুষের আত্মোৎসর্গ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। এরই প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী ভারত ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়। এটা এমন সময়ে ঘটে যখন পাকিস্তানের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরপর মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই, ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী প্রায় ৯৩ হাজার সেনাসহ আত্মসমর্পণ করেন। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামরিক আত্মসমর্পণ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়, সেই ছবিগুলো ইতিহাসের স্মারক হয়ে আছে। কিন্তু সেই ছবিগুলোই বড় একটি অস্বস্তিকর সত্য প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ওই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত রাখা হয়। সিলেটে রাখার অজুহাত হিসেবে বলা হয় তার হেলিকপ্টারে নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না; পরিকল্পিতভাবে ওসমানীর উপস্থিতি এড়িয়ে গিয়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে বাঙালি পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। কিন্তু ভারতের প্রকাশিত অনেক সরকারি ছবিতে দেখা যায়, তাকে হয় আড়ালে রাখা হয়েছে, অথবা ছবি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বিকৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা খাটো করে ভারতের কৃতিত্ব নেয়ার সুস্পষ্ট মানসিকতার প্রতিফলন।
স্বাধীনতার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী ভারতীয় সেনাদের আচরণ আমাদের জনগণকে ব্যথিত করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লøা- অন্য অনেক শহর থেকে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ইলেকট্রনিকস ও গহনার দোকান লুটের খবর পাওয়া যায়। কুমিল্লøা মেডিক্যাল থেকে তাদের স্প্রিং ম্যাট্রেস পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেখা যায়। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেজর আবদুল জলিল এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তার এই দেশপ্রেমিক প্রতিবাদের মূল্য ছিল ভয়াবহ, ভারতের ইচ্ছায় তাকে পরে চাকরি থেকে অপসারিত করা হয় বলে প্রচলিত আছে। এতে প্রমাণ হয়, ভারত অনেক ক্ষেত্রেই একজন সহমর্মী বন্ধুর ভূমিকায় নয়; বরং দখলদার সেনাবাহিনীর মতো আচরণ করেছে। স্বাধীনতার পর কয়েক মাস বাংলাদেশে ভারতীয় রুপি চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছিল- যা এক অর্থে অর্থনৈতিক নির্ভরতার ইঙ্গিত।
ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশত্যাগ করার সময় বহু উদ্ধারকৃত ও আত্মসমর্পণকৃত অস্ত্র সাথে নিয়ে যায়, যা প্রকৃতপক্ষে নবগঠিত বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে, ভারত বাংলাদেশের সাথে সমমর্যাদার রাষ্ট্র হিসেবে নয়; বরং এক ধরনের আধা-নির্ভরশীল উপপক্ষ হিসেবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক যত গভীর হয়েছে, ততই প্রকাশ পেয়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবতা- ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নয়; বরং একটি প্রভাবাধীন পরিসর হিসেবে দেখতে আগ্রহী। বিশেষ করে রাজনৈতিক সঙ্কট বা নির্বাচনকালীন সময়গুলোতে ভারতের ভূমিকা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোন দল ক্ষমতায় থাকবে, কোন নীতি গ্রহণ করা হবে, কিংবা কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হবে- এসব বিষয়ে ভারত প্রায়ই এমন অবস্থান নিয়েছে, যা বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না; বরং তা প্রায়শ সেই রাজনৈতিক শক্তিকেই সমর্থন করেছে যারা দিল্লির প্রতি অনুগত এবং তার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় আগ্রহী। এতে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা দমন হলেও তা ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করেনি।
গঙ্গা ও তিস্তাসহ সীমান্তবর্তী নদীগুলোর পানি বণ্টন ইস্যুতে ভারতের আচরণ বছরের পর বছর ধরে বৈরী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ বারবার বৈজ্ঞানিক ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের দাবি জানালেও ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমাদের কৃষি, পরিবেশ ও জীবিকার ওপর। ভারত বহুবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয়নি, নানা অজুহাতে সমস্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছে।
সীমান্ত হত্যা আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে না। কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী দীর্ঘ বছর ধরে বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে আসছে। গরু পাচারের অজুহাত দেখানো হলেও নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন নিরস্ত্র, সাধারণ মানুষ। ভারত কখনোই সীমান্ত হত্যা বন্ধে আন্তরিক উদ্যোগ নেয়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এটি দেখায়, ভারত নিরাপত্তা ইস্যুেকও মানবিকতার ঊর্ধ্বে রেখে কঠোর ও আধিপত্যবাদীভাবে ব্যবহার করে।
বাণিজ্য সম্পর্কেও ভারতের একতরফা সুবিধাভোগী মনোভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারত সব সময়ই তাদের পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজার খোলা রাখতে চেয়েছে; কিন্তু নিজেদের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশে নানা অজুহাত দেখিয়ে শুল্ক-অশুল্ক জটিলতা আরোপ করেছে। ফলে বাণিজ্য ভারসাম্য দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের পক্ষে অতিমাত্রায় ঝুঁকে আছে। সমতার ভিত্তিতে বাণিজ্য করতে ভারতের অনীহা স্পষ্ট করে যে, তারা বাংলাদেশকে সহযোগী নয়, বরং ভোক্তা বাজার হিসেবে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
ট্রানজিট ইস্যুতে দৃশ্যমান আগ্রহও ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার অংশ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সুবিধা তারা সবসময়ই চেয়েছে অগ্রাধিকারমূলক ভিত্তিতে; কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা, ভৌগোলিক স্থিতিশীলতা, কিংবা অর্থনৈতিক লাভ কতটা হবে- সেসব বিষয়ে কখনোই বাস্তবসম্মত অবস্থান নেয়নি; বরং অনেক সময় তারা ট্রানজিটকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যেন এটি দেয়া বাংলাদেশের দায়িত্ব।
সবমিলিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ যখনই সমান মর্যাদা, পারস্পরিক সম্মান, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনধিকারচর্চা না করা- এ তিন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগোতে চেয়েছে, ভারত তখনই আধিপত্যবাদী আচরণ দেখিয়েছে। কূটনীতির জায়গায় তারা প্রভাব বিস্তারকে গুরুত্ব দিয়েছে, বন্ধুত্বের জায়গায় নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, আর সহযোগিতার জায়গায় সুবিধাবাদী মনোভাব প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়, আর সেই চাওয়ার জায়গায় ভারতের এই বড় ভাইসুলভ আচরণ কখনোই আমাদের উপযোগী নয়; বরং এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং সম্পর্কের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সাথেও বারবার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান- প্রায় সব দেশই নানা সময়ে ভারতের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছে। বাংলাদেশও সেই একই বাস্তবতা অনুভব করেছে। ১৯৭১ সালে অর্জিত সার্বভৌমত্ব কোনো বাইরের শক্তির কাছে সমর্পণ করার মানসিকতা এই জাতির নেই এবং কখনো থাকবেও না। সাম্প্রতিক অতীতে ভারত এমন রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন দিয়েছে, যারা জনগণের অধিকার দমন করেছে। এ কারণে ভারতের ওপর মানুষের আস্থার সঙ্কট আরো গভীর হয়েছে। জনগণ বিশ^াস করে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের আগের দীর্ঘ সময়জুড়ে একটি অজনপ্রিয় কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ভারতীয় সমর্থনই টিকিয়ে রেখেছিল। সীমান্তে নিয়মিত হত্যা, বাংলাদেশের বাজার দখলের বাণিজ্যনীতি, ন্যূনতম মাশুলে একতরফা ট্রানজিট সুবিধা আদায়, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিষয়ে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পক্ষ নেয়ার চেষ্টার মতো বৈরী কর্মকা- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভারতের প্রতি অবিশ^াস গভীর করেছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বড় ব্যর্থতা হলো প্রতিবেশীদের সমমর্যাদার অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে না পারা। ফলে এ অঞ্চলে তারা ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে।
ভারত চাইলে একজন ভালো প্রতিবেশী হতে পারে, যদি তারা তাদের যবমবসড়হরপ ভড়ৎবরমহ ঢ়ড়ষরপু পর্যালোচনা করে এবং বাংলাদেশের সাথে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করে। আস্থা পুনর্গঠনের দায়িত্ব তাদের, আর আমাদের দায়িত্ব হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা, সতর্ক থাকা এবং আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ় থাকা।
বিজয় দিবসে আমরা যখন লাখো শহীদের ত্যাগ স্মরণ করি, তখন আমাদের নতুন করে অঙ্গীকার করতে হবে- আমরা দেশের স্বার্থে অবিচল থাকব।
বাংলাদেশ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। দেশপ্রেম কোনো স্লোগান নয়, এটি একটি দায়িত্ব, একটি নৈতিক শপথ। কোনো বাংলাদেশী যেন কখনো বিদেশী শক্তির হাতিয়ার হয়ে দেশের বিরুদ্ধে কাজ না করে। আমাদের স্বাধীনতা এসেছে রক্তের বিনিময়ে; সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে ঐক্য, সততা, দেশপ্রেম ও অটল সংকল্পের মাধ্যমে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
