সম্পাদকীয়

জানালার পাশে লাল-সবুজের হাতছানি

রাইয়ান আবদুল্লাহ
১৬ ডিসেম্বরের সকালটা শুরু হয়েছিল খুব ভোরে। চারদিক তখনও কুয়াশায় ঢাকা। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সুরের সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ভেসে উঠল দেশাত্মবোধক গান-
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’’

রাশেদের ঘুম ভেঙে গেল। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঠান্ডা বাতাস তার মুখ ছুঁয়ে গেল। পাশের বাড়ির ছাদে উড়ছে একটা লাল-সবুজ পতাকা। ভোরের আলোয় পতাকাটা ধীরে ধীরে নড়ছে, যেন খুব শান্তভাবে কিছু বলছে। রাশেদ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল।

আজ বিজয় দিবস। স্কুলে অনুষ্ঠান আছে, পতাকা উত্তোলন, গান, আলোচনা। কিন্তু আজকের সকালটা কেন যেন অন্যরকম লাগছে।

নাশতার টেবিলে দাদু চুপচাপ বসে চা খাচ্ছিলেন। মুখে খুব বেশি কথা নেই, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা।

“দাদু, আজ তুমি অফিসে যাবে না?” রাশেদ হেসে জিজ্ঞেস করল।

দাদু হালকা হেসে বললেন, “না, আজ আমি জানালার পাশেই থাকব।”

তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, “আজকের দিনটা ভালো করে মনে রাখিস।”

রাশেদ ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু কথাটা মাথার ভেতর থেকে গেল।

স্কুলের মাঠ আজ উৎসবের মতো। রঙিন ব্যানার, ফুল, আর ছাত্রদের কোলাহল। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় রাশেদ হঠাৎ খেয়াল করল-তার গলা কাঁপছে। কেন কাঁপছে সে নিজেও জানে না। শুধু পতাকার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এর ভেতরে অনেক গল্প লুকিয়ে আছে।

অনুষ্ঠান শেষে সে দ্রুত বাড়ি ফিরল।

ঘরে ঢ়ুকেই দেখল, দাদু সেই জানালার পাশেই বসে আছেন। জানালার বাইরে তাদের পুরোনো আমগাছ, গাছটার ডালে ডালে রোদ পড়ে ঝিলমিল করছে। আর তার পাশেই বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা।

“দাদু, তুমি সকাল থেকে এখানেই কেন?” রাশেদ জানতে চাইল।

দাদু জানালার বাইরে তাকিয়ে বললেন,
“এই জানালাটা দিয়ে একসময় আমি শুধু কল্পনা করতাম।”

“কল্পনা?” রাশেদের চোখ বড় হয়ে গেল।

দাদু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। বললেন সেই সময়ের কথা, যখন এই দেশটার নিজের কোনো পতাকা ছিল না, যখন মানুষ মনে মনে একটা স্বাধীন সকালের স্বপ্ন দেখত। বললেন-সবাই যে সাহসী ছিল তা নয়, ভয় ছিল, অনিশ্চয়তা ছিল, তবু একটা বিশ^াস ছিল।

“তুমি কি তখন খুব সাহসী ছিলে?” রাশেদ জিজ্ঞেস করল।

দাদু একটু হেসে মাথা নাড়লেন।
“না। আমি সাধারণই ছিলাম। কিন্তু আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম। সেটাই সবচেয়ে বড় শক্তি।”

রাশেদ বুঝতে পারল-সাহস মানে ভয় না থাকা নয়, ভয় নিয়েই সামনে এগোনো।

দুপুরে মা ডাক দিলেন, “চলো, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসি।”

দাদু লাঠি হাতে ধীরে উঠলেন। রাশেদ তার হাত ধরল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল-ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ, তরুণ-সবাই একসঙ্গে যাচ্ছে। কারও মুখে উল্লাস, কারও চোখে নীরব শ্রদ্ধা।

ফুল দেওয়ার সময় দাদু চোখ বন্ধ করলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাশেদ বুঝল, এই নীরবতার ভেতর অনেক নাম না বলা গল্প আছে।

ফেরার পথে দাদু বললেন,
“বিজয় মানে শুধু যুদ্ধ জেতা না। বিজয় মানে ভালো মানুষ হওয়া, নিজের কাজটা ঠিকভাবে করা।”

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রাশেদ পড়ার টেবিলে বসল। জানালার বাইরে তখনও পতাকাটা উড়ছে। দাদু চেয়ারে বসে সেটার দিকে তাকিয়ে আছেন।

রাশেদ খাতার প্রথম পাতায় বড় করে লিখল-
১৬ ডিসেম্বর

তার নিচে আরেক লাইনে লিখল-
ভয় থাকলেও আমি চেষ্টা করব।

সে জানে না ভবিষ্যতে সে কী হবে। কিন্তু আজ সে বুঝেছে-বিজয় দিবস মানে শুধু ইতিহাসের দিন নয়। এটা প্রতিদিন নিজের ভেতরে একটু সাহস জন্ম দেওয়ার দিন।

জানালার বাইরে লাল-সবুজ পতাকা বাতাসে দুলছে। আর রাশেদের মনে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক শান্ত, দৃঢ় স্বপ্ন-এই দেশ, এই বিজয়, একদিন তার কাজের মধ্য দিয়েও বেঁচে থাকবে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button