সম্পাদকীয়

সাইবার সহিংসতা রোধে সমন্বিত উদ্যোগ অত্যাবশ্যক

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অভিযাত্রায় প্রযুক্তি আজ আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাইবার সহিংসতা-বিশেষত নারী, কন্যা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অনলাইন আক্রমণ। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখাচ্ছে, সাইবার সহিংসতা এখন শুধুমাত্র সামাজিক সমস্যাই নয়, বরং মানবাধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। নারীর কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা বা ভূমিকার পরিবর্তে তার লিঙ্গ, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, পোশাক বা যৌন পরিচয়কে কেন্দ্র করে অবমাননা-এগুলো সাইবার সহিংসতার ভয়াবহ দিক। আক্রমণের শিকার ব্যক্তিরা যখন ভয়ে, লজ্জায় বা প্রযুক্তিবিমুখতার কারণে আত্মরক্ষার পথ খুঁজে পান না, তখন আগ্রাসন আরও বাড়ে। তাই প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও আত্মরক্ষার সক্ষমতা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সম্প্রতি নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতার প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে মহিলা পরিষদের মতবিনিময় সভায় এই বাস্তবতাই উঠে এসেছে। বক্তারা যথার্থভাবেই বলেছেন-সাইবার আক্রমণ আজ শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের সমান প্রভাব সৃষ্টি করছে। এই জটিলতা মোকাবিলায় প্রযুক্তির সঙ্গে আইন, প্রশাসন ও সমাজ-সবকিছুকে সমান্তরালভাবে এগোতে হবে। অধ্যাপক নোভা আহমেদ যে সুপারিশগুলো তুলে ধরেছেন-তার মধ্যে প্রযুক্তি শিক্ষায় সহায়তা চাওয়ার কৌশল যুক্ত করা, আইন প্রয়োগে দ্রুততা আনা, বিচার প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা-এসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতায় আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো যত শক্তিশালীই হোক, প্রযুক্তিজ্ঞানহীন মানুষের পক্ষে সাইবার প্রতিরোধ গড়ে ওঠা কঠিন। এজন্য স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কমিউনিটি পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহারকে স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। বিটিআরসি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থা-তিন পক্ষের সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। বিটিআরসি আইনগত সীমাবদ্ধতার কথা বললেও, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া সাইবার অপরাধ মোকাবিলা সম্ভব নয়। একইভাবে, ভুক্তভোগী এবং সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা এখন অত্যাবশ্যক। এআইয়ের অপব্যবহার-বিশেষ করে ডিপফেইক ভিডিও, ভুয়া ছবি বা বিকৃত তথ্য-একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। সচেতনতা, আইন প্রয়োগ এবং প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান দক্ষতা না বাড়ালে এই আক্রমণ আরও ভয়াবহ হবে। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য জরুরি তিনটি বিষয়-প্রযুক্তি জ্ঞান, আইন প্রয়োগের কার্যকারিতা এবং সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন। বিশেষত নারীর প্রতি বিদ্বেষ, অবমাননা ও লিঙ্গবৈষম্য দূর না হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ডিজিটাল যুগে মানুষকে প্রযুক্তির ভয় নয়, প্রযুক্তিকে দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা দিতে হবে। সাইবার সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধই হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button