সম্পাদকীয়

বায়ুদূষণ: উন্নয়নকে গ্রাস করা নীরব সংকট

দক্ষিণ এশিয়ার ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি ও হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলে বায়ুদূষণ এখন আর কেবল পরিবেশগত উদ্বেগ নয়, এটি একটি গভীর উন্নয়ন সংকটে রূপ নিয়েছে। বিশ^ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এই অঞ্চলের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ^াস নিচ্ছেন এবং প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যুর পেছনে বায়ুদূষণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। এই ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে সামনের সারিতে। বিশ^ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব-সব মিলিয়ে এটি উন্নয়নের ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দূষণের প্রধান উৎসগুলো নতুন নয়। রান্না ও গরম করার জন্য কঠিন জ্বালানির ব্যবহার, সনাতন ইটভাটা, ফিল্টারবিহীন শিল্পকারখানা, পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, কৃষিজ অবশিষ্টাংশ ও বর্জ্য পোড়ানো-সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। রাজধানী ঢাকায় অব্যাহত নির্মাণকাজ, বড় অবকাঠামো প্রকল্প এবং দুর্বল নজরদারির কারণে শীত মৌসুমে বায়ুর মান প্রায়ই বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তঃসীমান্ত প্রভাব। শীতকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দূষিত বায়ু উচ্চচাপ বলয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যা ঢাকার মতো শহরগুলোকে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলে। একইভাবে বছরের অন্য সময়ে বাংলাদেশের দূষণও প্রতিবেশী দেশে পৌঁছে। ফলে বায়ুদূষণ কোনো একক দেশের সমস্যা নয়; এটি একটি আঞ্চলিক বাস্তবতা। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদন আশার কথাও শোনায়। সেখানে দূষণের উৎসে নির্গমন কমানো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তুলে ধরা হয়েছে। বৈদ্যুতিক রান্না, পরিষ্কার জ্বালানি, আধুনিক শিল্প প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক ও মোটরচালিত পরিবহন এবং উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-এসব সমাধান নাগালের মধ্যেই রয়েছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে শুধু পরিবেশ নয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্জনও ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাই এখন প্রয়োজন নীতি-প্রতিশ্রুতির বাইরে গিয়ে কার্যকর বাস্তবায়ন, টেকসই অর্থায়ন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সহযোগিতা। বিশুদ্ধ বাতাস নিশ্চিত করা বিলাসিতা নয়-এটি জীবন, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button