সম্পাদকীয়

অরক্ষিত বধ্যভূমি, দীর্ঘসূত্রিতা ও রাষ্ট্রের দায়

ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন পার্কসংলগ্ন বধ্যভূমিটি একাত্তরের গণহত্যার নীরব সাক্ষী। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এই স্থানটি অরক্ষিত, অনাদৃত এবং প্রায় অদৃশ্য অবস্থায় পড়ে আছে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও দাপ্তরিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের এই রক্তাক্ত ইতিহাস আজও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। এটি শুধু একটি স্থাপনা নির্মাণের বিলম্ব নয়; এটি জাতীয় স্মৃতি সংরক্ষণে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। ২০২০ সালের বিজয় দিবস থেকে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ ধারাবাহিকভাবে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে। মানববন্ধন, স্মারকলিপি, সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তারা বিষয়টি জনসম্মুখে এনেছে। এই নাগরিক উদ্যোগের ফলেই প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে তদন্ত, প্রতিবেদন, নথি প্রেরণ ও প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ব্যয় নির্ধারণ, নকশা প্রণয়ন ও সংশোধিত প্রাক্কলন-সবই হয়েছে। তবু বাস্তব অগ্রগতি নেই। ২০২২ সালেই বধ্যভূমিটি ‘বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ আসে। ৯৯ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ের প্রাক্কলন চূড়ান্ত হয়। এরপরও বছরের পর বছর কেবল ফাইল চালাচালির মধ্যেই প্রক্রিয়া আটকে আছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে মন্ত্রণালয় জানায়, এটি সংশোধিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তালিকাভুক্ত। কিন্তু মাঠপর্যায়ে আজও একটি ইট বসেনি। এই দীর্ঘসূত্রিতা প্রশ্ন তোলে-রাষ্ট্র কি তার ইতিহাস রক্ষায় যথেষ্ট আন্তরিক? বধ্যভূমি কোনো সাধারণ জমি নয়। এটি শহীদদের রক্তে ভেজা ভূমি, জাতির আত্মত্যাগের দলিল। এ ধরনের স্থান সংরক্ষণ কেবল অতীত স্মরণ নয়; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস জানানো, গণহত্যার সত্য তুলে ধরা এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব। মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের ক্ষোভ তাই অমূলক নয়। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে-এই অবহেলা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান। নতুন জেলা প্রশাসক বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ^াস দিয়েছেন, যা ইতিবাচক। তবে আশ^াসের চেয়েও বেশি প্রয়োজন সময়বদ্ধ সিদ্ধান্ত ও কার্যকর বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা জরুরি। রাষ্ট্র যদি তার ইতিহাসকে দৃশ্যমান করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই শূন্যতা ভবিষ্যতে আরও বড় দায় হয়ে দাঁড়াবে। ময়মনসিংহের এই বধ্যভূমি সংরক্ষণ এখন আর শুধু একটি স্থানীয় দাবি নয়-এটি জাতীয় দায়িত্ব। দাপ্তরিক দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে সেই দায়িত্ব পালনের সময় অনেক আগেই এসে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button