খেলাপি ঋণ সংকট-সমাধানে জরুরি কাঠামোগত সংস্কার

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা ও অস্বচ্ছতার ফল হিসেবে খেলাপি ঋণ আজ জটিল এক সংকটে রূপ নিয়েছে। নীতি-সহায়তার আড়ালে ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ হওয়ার পর বাস্তব পরিস্থিতি স্পষ্ট হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ করেই সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকায় উঠে এসেছে। এ অবস্থা শুধু আর্থিক খাত নয়, পুরো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্যও বড় চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে শুধু এপ্রিল থেকে জুন-এই তিন মাসেই ব্যাংকগুলো প্রায় ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা করেছে, যার সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৯৭ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বর্তমানে মোট মামলায় ঝুলে থাকা অর্থ ৪ লাখ ৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা, যা বিগত মার্চের তুলনায় প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে-ব্যাংকগুলো আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর হলেও, সমস্যার গভীরতা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা চার থেকে সাতটিতে বাড়ানো একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। ফলে গত তিন মাসে ১১ হাজার ৯৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি এবং ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা আদায় সম্ভব হয়েছে, যা গত প্রান্তিকের তুলনায় উন্নতি। তবে মামলার তুলনায় নিষ্পত্তির হার এখনো খুবই কম, এবং এর ফলে কোটি কোটি টাকা দীর্ঘদিন আটকে থাকার ঝুঁকি তৈরি হয়-যা ব্যাংকের হিসাব, তারল্য ও ঋণপ্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকার অর্থঋণ আদালত আইনে কঠোরতা যুক্ত করে মামলাজট কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণগ্রহীতার নামে-বেনামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও বিক্রির সুযোগ, আপিল বা রিভিউর আগে ঋণের বড় অংশ জমা দেওয়ার শর্ত-এসব প্রস্তাব ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াকে দ্রুত করতে পারে। তবে এসব কঠোরতা কার্যকর করতে প্রয়োজন প্রশাসনিক সক্ষমতা, স্বচ্ছতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বৃহত্তর সমন্বয়। ব্যাংকগুলো যে বিপুল অর্থ রিট এবং আদালত-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে আছে, তা অর্থনীতির ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অচল মূলধন নতুন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে, যা কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলে। এ কারণে হাইকোর্ট বিভাগে রিট দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে, মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছর মেয়াদি বিশেষ পুনঃতফসিল সুবিধার আবেদন সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে-এটিও উদ্বেগজনক। শীর্ষ ২০ ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছ থেকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি পুনঃতফসিল চাওয়া দেখায়, বড় ঋণগ্রহীতাদের ওপর ঝুঁকি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুনঃতফসিল অবশ্যই করা উচিত, তবে তা যেন প্রকৃত অসুবিধায় পড়া প্রতিষ্ঠান ও সৎ ঋণগ্রহীতার জন্য হয়-এ বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পুনরুদ্ধারের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিনির্ধারণ। খেলাপি ঋণ সংকট শুধু মামলার সংখ্যা বা টাকার অঙ্কে সীমাবদ্ধ নয়-এটি অর্থনীতির বিশ^াসযোগ্যতা ও ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। তাই দীর্ঘসূত্রতা কাটিয়ে দ্রুত ও দৃঢ় কাঠামোগত সংস্কারই এখন সময়ের দাবি।
