মূল্যস্ফীতির চাপ কমলেও স্বস্তি এখনও দূরে

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সামান্য ঊর্ধ্বগতিতে এটি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে, যা আগের মাসের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে-এক বছর আগে এটি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এই তুলনা জানান দেয়, স্বল্পমেয়াদে চাপ বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে কিছুটা স্থিতি ফিরে এসেছে অর্থনীতিতে। নভেম্বরের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাতের চিত্র বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা নির্দেশ করে নিত্যপণ্যের বাজারে এখনও অস্থিরতা রয়ে গেছে। অপরদিকে খাদ্যবহির্ভূত খাতে সামান্য হ্রাস সত্ত্বেও ৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দেয়। গ্রামীণ ও শহুরে উভয় এলাকায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যদিও শহরে হার কিছুটা বেশি। এটি স্পষ্ট করে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়; বরং দেশের সর্বত্র বাজার অস্থিরতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। গড় মূল্যস্ফীতির (মুভিং অ্যাভারেজ) চিত্র আরও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা আগের সময়ের তুলনায় কম। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে সরকারের নীতি পদক্ষেপ এবং বিশ^বাজারের কিছু স্থিতি সামগ্রিকভাবে মূল্যচাপ কমাতে ভূমিকা রাখছে। তবে প্রায় ৯ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি এখনও নীতিনির্ধারকদের জন্য সতর্কসংকেত হিসেবে বিবেচ্য। অন্যদিকে মজুরি বৃদ্ধির হারও অর্থনীতির গুরুত্বপ্র্ণূ সূচক। নভেম্বরে জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি। ফলে প্রকৃত মজুরির দিক থেকে শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটছে-এমন দাবি করা কঠিন। কৃষি, শিল্প ও সেবা-তিন খাতেই মজুরি বৃদ্ধি স্থিতিশীল থাকলেও মূল্যস্ফীতিকে ছাড়িয়ে যেতে না পারায় জীবনযাত্রার ব্যয় জনগণের ওপরই অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন বহুমুখী পদক্ষেপ। বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-ব্যয় দক্ষতা এবং উৎপাদন খাতে প্রণোদনা-সবকিছুই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা এবং শ্রমজীবী মানুষের আয় রক্ষায় নীতিগত সহায়তা জরুরি হয়ে উঠেছে। মূল্যস্ফীতির হার সামগ্রিকভাবে কমার যে ইঙ্গিত মিলছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই স্বস্তি ঘোষণা করার সুযোগ নেই। বাজারে স্থিতিশীলতা এবং পরিবারের ব্যয়চাপ কমানোই আগামী দিনের প্রধান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ-যার মোকাবিলায় প্রয়োজন আরও কার্যকর, স্বচ্ছ ও সমন্বিত নীতি প্রয়োগ।
