সম্পাদকীয়

পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে পদ্মা

হেমন্ত শেষ হতে না হতেই শীতের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেশ। এমন সময়ে পদ্মার যে চিত্র সামনে এসেছে, তা বহু বছর পর এক ভিন্ন বার্তা বহন করে। সাধারণত এ মৌসুমেই নদীর জল কমে আসে; কিন্তু এ বছর পদ্মা তার ব্যতিক্রমী রূপ দেখিয়েছে। দীর্ঘ সময় পানি থাকার ফলে নদীর প্রাণপ্রবাহ যেমন শক্তিশালী হয়েছে, তেমনি বদলে গেছে আশপাশের ইকোসিস্টেম ও মানুষের জীবনযাত্রা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে থেকে জানা গেছে, রাজশাহীর জেলে মিজানুর রহমানদের মুখে আবার হাসি। টানা ছয় মাস মাছ ধরা-এটি শুধু জীবিকা নয়, নদীর স্বাভাবিকতার লক্ষণও। ট্যাংরা, বোয়াল, আইড়সহ দেশি মাছের প্রাচুর্য প্রমাণ করে নদীর প্রজনন ক্ষেত্রগুলো এ বছর পুনরায় সক্রিয় হয়েছিল। গবেষকদের মতে, উপরিউক্ত প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে প্রধানত ভারতের উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখ-, নেপালসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পানিপ্রবাহ নদীর আয়তন বাড়িয়েছে এবং জীববৈচিত্র্যকে ফিরিয়ে এনেছে। এর একটি বড় উদাহরণ-বিলুপ্ত হিসেবে ঘোষিত মিঠাপানির কুমিরের পদ্মায় পুনরাবির্ভাব। ঘটনাটি শুধু প্রতীকী নয়; এটি ইঙ্গিত দেয় নদী আবার তার স্বরূপের দিকে যাচ্ছে। গাঙ্গেয় ডলফিন, ঘড়িয়াল এবং দেশি প্রজাতির বহু প্রাণীর ফিরে আসার সম্ভাবনা তাই অমূলক নয়। তবে এই ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিও। অতিবৃষ্টি ও পানির ঢলে নদীভাঙন বেড়েছে, চরাঞ্চলের ব্যাপক ভূমি বিলীন হয়েছে। আগাম সবজি চাষ ব্যাহত হওয়ায় কৃষকের লোকসান স্পষ্ট। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা-মাত্র ১১ মাসে রামেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১,৪৪৮ জন, নিহত ৫০ জন। দীর্ঘসময় পানিতে থাকার ফলে বন্যপ্রাণী মানুষের বাসস্থানের দিকে চলে আসা যে ঝুঁকি সৃষ্টি করে, এ বছর তার প্রকট উদাহরণ মিলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বিগত দুই বছরের তুলনায় পদ্মায় সর্বনি¤œ পানির স্তরও এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকায় খাল-বিলও জীবন্ত হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য আশাব্যঞ্জক মনে করছেন। বিশেষ করে বড়াল নদীর পুনঃখনন ও পানি সংরক্ষণ প্রকল্পসমূহ কার্যকর হলে এই জলসম্পদ দীর্ঘমেয়াদি টেকসই ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। সব মিলিয়ে পদ্মার এ বছরের রূপ আমাদের পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্রের প্রতি নতুন করে দৃষ্টি দিতে শেখায়। নদী তার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেলে সে মানুষকে শুধু সম্পদই দেয় না-নিরাপত্তা, খাদ্য, পানি ও প্রাণবৈচিত্র্যের ভারসাম্যও রক্ষা করে। কিন্তু একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়-জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি বা অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহে বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। নদীর এই পুনর্জাগরণকে তাই শুধু উৎসব নয়, দায়িত্বের চোখে দেখা জরুরি। পরিকল্পিত নদীব্যবস্থাপনা, চরাঞ্চলের সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং টেকসই পানি ব্যবহার-এসবই এখন সময়ের দাবি। পদ্মা আজ যে সজীবতার বার্তা দিচ্ছে, তা যেন আগামী প্রজন্মের জন্যও টিকে থাকে-এই প্রত্যাশাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও পরিবেশ নিরাপত্তার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button