সম্পাদকীয়

সড়ক নিরাপত্তায় রাষ্ট্রের পরীক্ষার সময়

নভেম্বর মাসের দুর্ঘটনা পরিসংখ্যান আবারও দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে এনেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, মাত্র এক মাসে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ৫৭৭টি দুর্ঘটনায় ৫৫৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৯০০ জন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাই সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়েছে-৫২৬টি ঘটনায় ৫০৭ জনের মৃত্যু। এই পরিসংখ্যান নিছক সংখ্যা নয়; এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, দুর্বল প্রয়োগ ও দীর্ঘদিনের অবহেলার প্রতিফলন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৩৯ শতাংশ এবং নিহতের ৪১ শতাংশই মোটরসাইকেল সংশ্লিষ্ট। নগর ও গ্রাম-উভয় এলাকায়ই মোটরসাইকেলের সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার হয়নি। অদক্ষ চালক, হেলমেট ব্যবহার না করা, বেপরোয়া গতি এবং উল্টো পথে চলাচল এই খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ভৌগোলিক বিশ্লেষণেও বৈষম্য স্পষ্ট। ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা সর্বাধিক। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কেই ঘটেছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা, যেখানে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে ধীরগতির ও ঝুঁকিপূর্ণ যান একসঙ্গে চলাচল করে। মিডিয়ানহীন সড়ক, অপর্যাপ্ত সাইন ও মার্কিং এবং সার্ভিস লেনের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি কোনো একক শ্রেণির সমস্যা নয়। চালক, পথচারী, নারী, শিশু, শিক্ষার্থী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও এর শিকার হচ্ছেন। অর্থাৎ সড়ক অনিরাপদ-সবার জন্যই। বিশেষ করে শিশু ও শিক্ষার্থীদের মৃত্যু সামাজিকভাবে গভীর উদ্বেগের কারণ। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যেসব বিষয় উঠে এসেছে-ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, ট্রাফিক আইন অমান্য, চাঁদাবাজি, বিশ্রামহীন চালনা-এসব নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এগুলো চিহ্নিত, কিন্তু কার্যকর সমাধান দৃশ্যমান নয়। আইন আছে, নীতিমালা আছে, এমনকি কৌশলগত পরিকল্পনাও রয়েছে; ঘাটতি মূলত বাস্তবায়নে এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সুপারিশগুলো বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। তবে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, প্রয়োজন সমন্বিত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ। ডিজিটাল ফিটনেস, দক্ষ চালক তৈরির ব্যবস্থা, নিয়মিত রোড সেফটি অডিট এবং আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ-এসবই হতে হবে ধারাবাহিক ও জবাবদিহিমূলক। নভেম্বরের এই পরিসংখ্যান সতর্কবার্তা। সড়ক নিরাপত্তা এখন আর কেবল পরিবহন খাতের সমস্যা নয়; এটি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও মানবিক সংকটের সঙ্গে জড়িত। প্রাণহানি কমাতে হলে শোক নয়, চাই কার্যকর ও টেকসই সিদ্ধান্ত।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button