সম্পাদকীয়

ভেজাল ওষুধের অরাজকতা: জনস্বাস্থ্যের নীরব বিপর্যয়

 

চট্টগ্রামের ফার্মেসিগুলোর বাস্তব চিত্র শুধু একটি শহরের সমস্যা নয়, এটি দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার গভীর দুর্বলতার প্রতিফলন। জ্বরের সাধারণ ওষুধেও ভেজালের শিকার হওয়া স্কুলশিক্ষক রেজাউল করিমের অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রম নয়; বরং হাজারো মানুষের নিত্যদিনের বাস্তবতা। ওষুধ-যার ওপর মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করে-সেটিই যখন অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তখন তা নিছক ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন নয়, একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট। পত্রপত্রিকা তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম নগর ও উপজেলাজুড়ে হাজারের বেশি ফার্মেসি লাইসেন্স ছাড়াই চলছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ বিদেশি ওষুধ, এমনকি শিশুদের নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। অনেক ক্ষেত্রে ফার্মেসি মালিকরাই নিজেদের ‘ডাক্তার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অজ্ঞতা, লোভ ও নিয়ন্ত্রণহীনতার এই মিশ্রণ সরাসরি মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো-এই অরাজকতা নতুন নয়, কিন্তু কার্যকর প্রতিরোধ নেই। ওষুধ ও কসমেটিকস আইন, ২০২৩-এ ভেজাল ও নকল ওষুধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ প্রায় অনুপস্থিত। ৩৫ বছরে ড্রাগ আইনে মাত্র ১৫টি মামলা-এই পরিসংখ্যান আইন প্রয়োগের দৈন্যদশা স্পষ্ট করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধও সামান্য জরিমানায় নিষ্পত্তি হচ্ছে, যা অপরাধীদের জন্য কার্যত উৎসাহে পরিণত হয়েছে। তদারকি সংস্থার সীমাবদ্ধতাও বাস্তব। দেড় কোটির বেশি মানুষের চট্টগ্রামে সাত হাজার ফার্মেসি তদারকিতে মাত্র দুইজন কর্মকর্তা-এ চিত্র থেকেই বোঝা যায় কেন নজরদারি দুর্বল। তবে জনবল সংকট বাস্তব হলেও আইন না জানা, বিশেষ আইন এড়িয়ে অন্য আইনে মামলা করা কিংবা নিয়মিত ড্রাগ আদালত সক্রিয় না রাখার দায় এড়ানো যায় না। এর প্রভাব বহুমাত্রিক। ভুল ওষুধ ও ভেজাল অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে রোগ জটিল হচ্ছে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে সৎ ও লাইসেন্সধারী ফার্মেসিগুলোকেও সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে, যা নৈতিক ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিচ্ছিন্ন অভিযান নয়, প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। ড্রাগ লাইসেন্স ও ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসি বন্ধে শূন্য সহনশীলতা, নিয়মিত ড্রাগ আদালতের কার্যক্রম, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিশেষ আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, জনবল ও লজিস্টিক শক্তিশালীকরণ এবং ভোক্তাদের সচেতনতা-সবকিছু একসঙ্গে কার্যকর করতে হবে। ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে লড়াই আসলে মানুষের জীবনের পক্ষে দাঁড়ানোর লড়াই। এখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই। কঠোর আইন আছে; এখন দরকার তার নিরপেক্ষ ও ধারাবাহিক প্রয়োগ। না হলে এই নীরব বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button