তালা ঝুলছে আইসিইউতে, ধুলায় ঢেকে যন্ত্রে-এ কেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা

বাগেরহাট জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা ভরসা ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল। অথচ এই হাসপাতালেই কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত পড়ে আছে, তালা ঝুলছে আইসিইউ ইউনিটে। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার নামে কেনা সরঞ্জাম যখন বছরের পর বছর অচল থাকে, তখন তা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতাই নয়-এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে নির্মম উপহাস। তিন বছর ধরে ৩৮ লাখ টাকার অটোমেটিক বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন বাক্সবন্দী পড়ে থাকা চরম অব্যবস্থাপনার উদাহরণ। প্রতি ঘণ্টায় শত শত নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মেশিনটি চালু না হওয়ায় মাসে ছয় হাজারের বেশি রোগী আধুনিক পরীক্ষাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা না পাওয়া কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীরবতা-যে কারণই দেখানো হোক না কেন, এর দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকেই নিতে হবে। কেনা যন্ত্র চালু করতে না পারা মানে সরকারি অর্থের অপচয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে দীর্ঘস্থায়ী করা। এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র হাসপাতালের ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট। ভেন্টিলেটর, মনিটর, ডিফিব্রিলেটরসহ প্রয়োজনীয় সব আধুনিক সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জনবল সংকটে এক বছর ধরে পুরো ইউনিটটি বন্ধ। করোনা মহামারির সময় যে আইসিইউ বহু প্রাণ বাঁচিয়েছে, প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি অচল হয়ে যাওয়া প্রশ্ন তোলে-আমাদের স্বাস্থ্যখাতে কি সবকিছু প্রকল্পনির্ভর? প্রকল্প শেষ মানেই কি সেবা বন্ধ? আইসিইউ বন্ধ থাকায় মুমূর্ষু রোগীদের খুলনা বা ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা এসব রোগীর ক্ষেত্রে এই রেফারই অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যয়, যাতায়াতের ঝুঁকি এবং মানসিক চাপ-সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চিকিৎসক ও নার্স সংকট প্রকট। ৫৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ২৬ জন চিকিৎসক। এটি নিঃসন্দেহে একটি কাঠামোগত সমস্যা। তবে প্রশ্ন হলো, জনবল সংকট জেনেও কেন আইসিইউ চালুর আগে টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি? কেন যন্ত্রপাতি সরবরাহের আগে ইনস্টলেশন, রক্ষণাবেক্ষণ ও জনবল নিশ্চিত করা হয় না? স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মৌলিক অধিকার। বাগেরহাটের মতো একটি জেলার মানুষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শত কিলোমিটার পাড়ি দিতে বাধ্য করা রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর শামিল। অবিলম্বে অচল যন্ত্রপাতি চালু, আইসিইউর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। নইলে তালাবদ্ধ আইসিইউ আর ধুলোমাখা যন্ত্রপাতি আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতার নীরব সাক্ষী হয়েই থাকবে।
