স্থানীয় বন্দুকধারীদের গুলির মুখে ফিলিস্তিনিরা

প্রবাহ ডেস্ক : ত্রাণ নিতে গিয়ে আবারও গোলাগুলির মধ্যে পড়েছেন গাজার ফিলিস্তিনিরা। গত সোমবার ইসরায়েল ও মার্কিন সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন, জিএইচএফ পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাওয়ার সময় তাদের ওপর আবারও গুলি চালানো হয় বলে দাবি ফিলিস্তিনিদের। খবর বিবিসির। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এবারই প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরাও তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। দক্ষিণ রাফাহর তাল আল-সুলতান এলাকায় জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে এই ঘটনা ঘটে। এ সময় ইসরায়েলি সেনারাও তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ত্রাণ সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত ওই এলাকায় ছয়জন নিহত এবং ৯৯ জন আহত হয়েছেন। প্রতিবেদনগুলো খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তবে জিএইচএফ বলছে, তাল আল-সুলতান কেন্দ্রটি সোমবার খোলাই হয়নি এবং ত্রাণ বিতরণ করার জন্য খোলা অন্য দুটি সাইটেও কোনো ঘটনা ঘটেনি। গাজার হামাসবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়ার কয়েকদিন পরই এমন ঘটনা ঘটলো। গত ২৬ মে, গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন ত্রাণ বিতরণ শুরু করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই, তাদের খোলা চারটি ত্রাণ কেন্দ্রের কোনো একটির কাছে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলের একটি সামরিক অঞ্চলের ভেতর দিয়ে রাফাহর তাল আল-সুলতান এলাকার একটি কেন্দ্রে যাওয়ার পথে অনেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আগের ঘটনাগুলোতে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, ইসরায়েলি বাহিনী মানুষের ভিড়ের ওপর গুলি চালিয়েছিল। যদিও সহায়তা কেন্দ্রে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালানোর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের দাবি, সৈন্যরা সন্দেহভাজনদের ওপর গুলি চালিয়েছিল যারা সতর্কতামূলক গুলি উপেক্ষা করে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। গত সোমবারের ওই ঘটনায়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা লোকজন জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর পাশাপাশি ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরাও তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। তারা বলেছে, বন্দুকধারীদের ইসরায়েলি বাহিনীর মিত্র বলেই মনে হচ্ছিল, যেন তারা একসঙ্গে অভিযান চালিয়ে আবার ইসরায়েলি সামরিক অঞ্চলেই ফিরে গিয়েছিল। বিবিসি আরবি’র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দৈনিক অনুষ্ঠানে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, জিএইচএফ কেন্দ্র থেকে খাদ্য সহায়তার বক্স নিতে তিনি যখন ওই এলাকায় পৌঁছান, তখন বেসামরিক পোশাক পরা এবং মুখ সম্পূর্ণরূপে ঢাকা একদল যুবককে দেখেতে পান। হিশাম সাঈদ নামের ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলছিলেন, প্রথমে, আমরা ভেবেছিলাম তারা হয়তো ফিলিস্তিনি যুবক, যারা এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করছে, কিন্তু হঠাৎ করেই তারা আমাদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করে। এমনকি যারা সাহায্যের বক্স নিতে পেরেছিল তাদেরকে লক্ষ্য করেও গুলি করা হয়েছিল। আমরা এখনও জানি না যে কারা এই আক্রমণকারীরা। তারা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। এমনকি বিশৃঙ্খলার সময় আমাদের কাছ থেকে চুরিও করেছে কেউ কেউ, তিনি আরও উল্লেখ করেন। মোহাম্মদ সাকাউত নামে আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছিলেন, আমার ঠিক পিছনে থাকা বেশ কয়েকজন যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। কয়েকটি গুলি তো আমার মাথার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে গেছে। শুরুতে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। কিন্তু আজ, গ্যাং এবং মিলিশিয়াদের উপস্থিতি দেখে আমরা হতবাক হয়েছি, তিনি আরও যোগ করেন। খান ইউনিস শহরের কাছাকাছি নাসের হাসপাতালে, ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন মোহাম্মদ কাবাগা নামে এক ব্যক্তি। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে তিনি বলেন, এক স্থানে জড়ো করে মুখোশধারী সশস্ত্র ব্যক্তিদের একটি দল সরাসরি আমাদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করে। তিনি বলেন, আমরা সেখানে সাহায্য নিতে গিয়েছিলাম। তারা লাইনে দাঁড়াতে বলল। আমরা লাইনে দাঁড়ালাম এবং হঠাৎ করেই তারা আমাদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করল। আমি যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, একটি গুলি আমার শরীরে লাগলে আমি অবাক হয়ে গেলাম, হতবুদ্ধি হয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম আমি। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বিবিসিকে জানিয়েছে যে, তারা প্রতিবেদনগুলো খতিয়ে দেখছে। জিএইচএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা সোমবার সৌদি আরবের রাফাহ এবং ওয়াদি গাজা উপত্যকা এলাকায় দুটি ত্রাণ কেন্দ্র খুলেছে এবং উভয় স্থানেই কোনও ঘটনা ছাড়াই সাহায্য বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। তাল আল-সুলতানের ঘটনা সম্পর্কে বিবিসি’র প্রশ্নের জবাবে, জিএইচএফের একজন মুখপাত্র বলেন, আমাদের কেন্দ্রের আশেপাশে কিছুই ঘটেনি। তবে, গত সোমবার বিকেলে গ্রুপটির ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া একটি পোস্টে বলা হয়েছে যে “জনতার বিশৃঙ্খলার” কারণে তাল আল-সুলতান কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জিএইচএফের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিচালক জন অ্যাক্রি বলেছেন, তারা গত দুই সপ্তাহে “আমাদের বিতরণ কেন্দ্রে কোনও আঘাত বা বড় ধরনের ঘটনা ছাড়াই” ১ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, একই সময়ে “সহায়তা বিতরণের জন্য নির্ধারিত এলাকা” থেকে হাসপাতালগুলোতে মোট ১২৭ জনকে মৃত অবস্থায় এবং ১,২৮৭ জন আহত ব্যক্তিকে আনা হয়েছে। মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদারদের মাধ্যমেই কাজ করে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে জাতিসংঘকে এড়িয়ে যেতে চায় তারা। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদানকারী গোষ্ঠীগুলো নতুন এই ব্যবস্থার সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের মতে, এটি নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতার মানবিক নীতির লঙ্ঘন। তারা এও সতর্ক করেছে যে, প্রায় তিন মাস ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধে, যা তিন সপ্তাহ ধরে আংশিক শিথিল করা হয়েছে, গাজার ২১ লক্ষ মানুষ ভয়াবহ ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলেছে, জিএইচএফের নেওয়া ব্যবস্থা হামাসের সহায়তা চুরির চেষ্টা রোধ করবে, যে অভিযোগ হামাস অস্বীকার করে আসছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার জবাবে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয় হামাসের ওই হামলায়। এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তখন থেকে ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় গাজায় কমপক্ষে ৫৪ হাজার ৯২৭ জন নিহত হয়েছেন।