খুলনায় ঠিকাদার বালা হত্যাকা- : তদন্তেই পাঁচ বছর!

সাবিহাসহ অন্যান্য আসামিরা ঘুরছে মুক্ত বাতাসে, নিরাপত্তাহীনতা ও তদন্তে ধীর গতিতে হতাশ পরিবার, ন্যায় বিচার এবং খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি স্ত্রী’র
স্টাফ রিপোর্টার ঃ মো. মিজানুর রহমান বালা (৫০)। নগরীর বাগমারা মেইন রোড এলাকার মৃত জহুরুল হকের পুত্র। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সানি এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী। একই সাথে তিনি ছোট ভাই যুবলীগ নেতা এসএম মেজবাহ হোসেন বুরুজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও দেখাশুনা করতেন। কিন্তু ছোট ভাইয়ের আকষ্মিক মৃত্যুর পর তার জীবনও হুমকিতে পড়ে। মূলতঃ প্রয়াত ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, যুবলীগ নেত্রী সাবিহা খাতুন শিপু’র উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়াকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বালা’র বিরোধের সূত্রপাত হয়। যার জেরে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রাতে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। এদিকে, চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত এ হত্যাকান্ডের প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও ‘তদন্ত’-ই শেষ হয়নি। মামলাটি নিয়ে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডি। কিন্তু এখনও চার্জশিট প্রস্তুত করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম। এজাহারে উল্লিখিত দু’ জন প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়া তিনি অভিযোগপত্র প্রস্তুত করতে পারছেন না- উল্লেখ করে আগামী এক/দেড় মাসের মধ্যে তিনি আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তবে‘তদন্ত’র নামে ধীরগতি ও সময়ক্ষেপনের সুযোগে জামিনে মুক্ত হয়ে এজাহারভূক্ত প্রধান আসামি সাবিহা খাতুন শিপুসহ অন্যান্য আসামিরা মুক্ত বাতাসে নিঃশ^াস নিচ্ছেন। যদিও ঘটনার পর সাবিহাসহ ৫ আসামিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। অপরদিকে, সন্তানদের নিরাপত্তাহীনতা এবং মামলার তদন্তে ধীর গতিতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে খুলনা ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকাদার মিজানুর রহমান বালা’র পরিবারের সদস্যরা। অবিলম্বে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট দাখিল করে ন্যায় বিচার এবং খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন মামলার বাদি নিহতের স্ত্রী ছাহেরা খাতুন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঠিকাদার মিজানুর রহমান বালা’র ছোটভাই এসএম মেজবাহ হোসেন বুরুজ ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও খুলনার প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। বুরুজের সকল ঠিকাদারি ব্যবসা দেখাশোনা করতেন বড় ভাই বালা। ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর বুরুজ মারা যান। এরপর বুরুজের স্ত্রী সাবিহার সঙ্গেও ব্যবসা দেখাশোনা করতেন বালা। তবে বুরুজের মৃত্যুর কিছুদিন পর ব্যবসা নিয়ে সাবিহার সঙ্গে বালার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এছাড়া সাবিহার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও অকারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়ায় তার সঙ্গে বালা’র দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে বুরুজের কয়েকশ’ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজের টাকার বড় একটি লভ্যাংশ পাবার কথা ছিল বালা’র। কিন্তু সেই লভ্যাংশ দিতে অস্বীকার করেন সাবিহা। এমনকি বালা’র কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ধার নিয়েও তিনি তা দিতে টালবাহানা করতে থাকেন।এরপর থেকেই অব্যাহতভাবে সাবিহা ও তার সহযোগীরা বালাকে জীবননাশের হুমকি দেন। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর বালা’র ওপর হামলা চালিয়ে প্রথম দফায় তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে যাত্রা ব্যর্থ হয় তাদের মিশন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রাত ৯টার দিকে ঠিকাদার মিজানুর রহমান বালা বাসায় ফেরার পথে নগরীর রায়পাড়া রোডস্থ দারুল উলুম মাদরাসার পূর্ব পাশে পৗঁছালে দুর্বৃত্তরা তার রিকশার গতিরোধ করে ধারালো ছুরি দিয়ে তার পেটে উপর্যুপরি আঘাত করে। হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় বালা’র স্ত্রী ছাহেরা খাতুন বাদী হয়ে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিরা হচ্ছে- বুরুজের স্ত্রী সাবিহা খাতুন শিপু, বুরুজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নগরীর আপার যশোর রোড এলাকার আনসারের পুত্র সজিব হাসান সাথী, নগরীর শেখপাড়া স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা বুরুজের দেহরক্ষী মোস্তফা সরদার সোনা, কর্মচারি ফয়সাল এবং শেখপাড়া এলাকার হাজী মো. হুদা মিয়ার পুত্র মাসুদ।
এজাহারে নিহতের স্ত্রী ছাহেরা খাতুন উল্লেখ করেন, ১ নং আসামি সাবিহা খাতুন শিপু’র স্বামী মৃত মেজবাহ হোসেন বুরুজ তার স্বামীর ছোট ভাই, যার ঠিকাদারী ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা তার স্বামী দেখাশুনা করতেন। মেজবাহ হোসেন বুরুজ মারা যাওয়ার পরে তার ব্যবসা সাবিহা খাতুন শিপু ও মিজানুর রহমান দেখাশুনা করেন। মেজবা হোসেন বুরুজ মারা যাওয়র পরে তার স্ত্রী সাবিহা খাতুন শিপু’র উৎশৃঙ্খল জীবন-যাপন এবং অকারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক অর্থ তুলে নেওয়ার কারণে সাবিহা খাতুন শিপুর সঙ্গে তার স্বামীর ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে চরম শত্রুতার সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রাত আনুমানিক ৯ টার সময়তার স্বামী রিক্সা যোগে বাসায়ফেরার পথে পথিমধ্যে খুলনা রায়পাড়া রোডস্থ দারুল উলুম মাদরাসার পূর্ব পার্শ্বে পৌঁছালে ২ থেকে ৫নং আসামিদের হাতে থাকা অস্ত্র বের করে আমার স্বামীর পথ আটকে রিক্সা থেকে জোর পূর্বক নামিয়ে ওয়ালের সাথে চেপে ধরে এবং ২নং আসামি তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে তার পেটে উপুর্যুপরি কোপ মারে। ইতিমধ্যে অপর একটি রিক্সাযোগে ঘটনাস্থলে তার ভাসুরের ছেলে অসীম এবং মামা শ^শুরের ছেলে রানা শেখ ২নং আসামিকে ছুরি মারারত অবস্থায় সাইদ দেখতে পেয়ে বাঁধা দিতে গেলে অজ্ঞাতনামা আসামীদের হাতে থাকা অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের আটকে রাখে এবং ৩নং আসামি তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে তার গলা এবং বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। তখন ৪ ও ৫নং আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আসামীরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থানেএলোপাতাড়িভাবে মারাত্মক আঘাত করে গুরুতর জখম করে। যাতে তার স্বামী রাস্তায়লুটিয়ে পড়লে আসামীরা মৃত মনে করে দ্রুত দৌঁড়ে চলে যাবার সময় অসীম এবং রানাকে শাঁসিয়ে যায় যে, এ ঘটনা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে বা মামলা মোকদ্দমা করলে তোদের পরিণতিও মিনাজুর রহমান বালার মত হবে। অতপর অসীম এবং রানা এ ঘটনায় হতবিহল হয়ে চিৎকার দিলে আসে পাশের লোকজন ছুটে আসে এবং মারাত্মক রক্তাক্ত আহত তার স্বামীকে দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। এজাহারে স্ত্রী ছাহেরা খাতুন আরও উল্লেখ করেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ১নং আসামির পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে উপরোক্ত আসামীরা পরস্পর যোগসাজসে আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। মামলার পর ৫ আসামিকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরই মধ্যে আসামি সাবিহার সহযোগীরা বিভিন্নভাবে বালার স্ত্রী-সন্তানদের হুমকি দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। বেশি ‘বাড়াবাড়ি’ করলে তাদের পরিণতিও বালা’র মতো হবে এমন হুমকিও দেওয়া হয়। এ অবস্থায় এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা থানার এসআই বিপ্লব কান্তি দাসের তদন্তে অনিয়ম দেখে কর্তৃপক্ষকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়। ওই সময় মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় খুলনা থানার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার মো. ইকবাল হোসেনকে। খুলনা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির ও মামলার নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন ওই সময় জানান, রিমান্ডে সাবিহা ও তার সহযোগীরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। মামলাটি অধিক তদন্তের স্বার্থে সাবিহাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। তবে পরবর্তীতে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। তারপর থেকে গত চার বছরে ৩/৪জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মামলার কোন অগ্রগতি বা পরিবর্তন হয়নি কিছুই। নিহতের স্ত্রী ছাহেরা খাতুন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ প্রতিবেদককে বলেন, তার স্বামী বালাকে সবাই ‘টোপ’ হিসেবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তাকে নিয়ে ‘গেম’ খেলা হয়েছে। এখন আর কেউ তাদের খোঁজ-খবরও নেয় না। যে কারণে নিরাপত্তাহীনতায় নিরুপায় হয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি খুলনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
মামলার তদন্তে ধীর গতিতে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর হতে যাচ্ছে। কিন্তু চার্জশিটটা পর্যন্ত দিতে পারলোনা সিআইডি। তিনি খুলনায় এসে একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি শুধু বলেন স্বাক্ষীদের নোটিশ করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে চান না। এভাবে আর কতদিন- প্রশ্ন করেন তিনি। ছাহেরা খাতুন তার স্বামী হত্যাকা-ের ন্যায় বিচার এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা সিআইডি’র ইন্সপেক্টর মো. রবিউল ইসলাম বলেন, মামলাটি তদন্তনাধীন আছে। ৪/৫জনের স্বাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী দু’জনের স্বাক্ষ্য এখনও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাদের স্বাক্ষী দিতে নোটিশ করা হয়েছে। এ দু’জনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আগামী এক/দেড় মাসের মধ্যে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে বলেও আশা করছেন তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইন্সপেক্টর মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বালা হত্যাকা-ের এজাহারভূক্ত আসামিরা তদন্তের ভিতরেই রয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি তিনি।