স্থানীয় সংবাদ

প্রতিরোধ, শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ একাত্তর

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
আমার গৌরব, আমি স্বাধীন দেশে মরে যেতে পারব। এ গৌরব আমার একার নয়, আমাদের অনেকের। এ গৌরবে পৌঁছার জন্য আমি অনেকের সঙ্গে লড়াই করেছি। কলোনিকালের কাছে আত্মসমর্পণ করিনি, কলোনিকালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি লেখার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের নিজেদের কয়েক ডিভিশন সৈন্য ছাড়াও আরও ছিল জামায়াতে ইসলামী, তাদের অঙ্গ সংগঠন আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের কয়েক ডিভিশন সামরিক-রাজনৈতিক সৈন্য। কলোনি রক্ষা করতে পারেনি তারা, হেরেছে এবং সারেন্ডার করেছে কলোনিবিরোধী বাঙালিদের কাছে। সে জন্য যুদ্ধটা ছিল কলোনিবিরোধী পাকিস্তানিদের দখলের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি, শেষ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই বাংলাদেশে এবং স্বাধীনভাবে মরতে চাই।
বাংলাদেশকে এভাবে তৈরি করেছি। দেশটা যেন বিভিন্ন আলোর ঝলকানি, আমি এই ঝলকানি জুড়িয়ে নিজের বুকে জড়ো করেছি। এভাবে তৈরি হয়েছে সামগ্রিক ভিশন। এর অর্থ : একইসঙ্গে বাইরে থেকে দেখা এবং ভেতর থেকে দেখা। নিজের মধ্যে যুক্ত করেছি সাহিত্য, দর্শন, শিল্পতত্ত্ব, মিথ। বাইরে থেকে আমাদের শতাব্দী দেখা, সাক্ষী হিসেবে এবং একইসঙ্গে এই শতাব্দীতে অংশগ্রহণ করেছি। এই হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক টেস্টিমনিয়াল, সৃষ্টিশীল কমিটমেন্ট। এই শতাব্দীর দর্শনের গভিড়ে প্রবেশ করে, শতাব্দীর নাটকীয়তার অভ্যন্তরে জায়গা খুঁজে নিয়ে, আমি বেঁচে আছি।
আমার ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, সে জন্য রুদ্ধ নয়। চেতনার স্বরূপ ভবিষ্যৎমুখী, বর্তমান সর্বমুহূর্তে সম্ভাবনার অভিঘাতে মথিত, যাকে বলা যায় সম্ভাবনার নিস্তব্ধ শক্তি। আমি অগ্রসর হতে থাকি স্বাধীনতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার দিকে, ভবিতব্যের বিরুদ্ধে আমি সমর্থন খুঁজে পাই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে। সে জন্য হতাশা এবং অবক্ষয় আমাকে উদ্দীপ্ত করে না, আমাকে উদ্দীপ্ত করে অসম্ভব বিপ্লবের সম্ভাবনা, অতীত থেকে আমি সরে আসি ভবিষ্যতের দিকে, যে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার দিকে, সৃষ্টিশীলতার দিকে স্পন্দমান। রুদ্ধ করে কোনো সময় টেকানো যায় না। আমি নিজের সময়কে একটা পরিস্থিতি হিসেবে বুঝতে চেয়েছি; পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছি একটা প্রজেক্টে, প্রজেক্টের লক্ষ্য : স্বাধীনতা, সেখানে পৌঁছতে হলে ভায়োলেন্সের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
সময়ের মধ্যে আমার অংশগ্রহণ সর্বমুহূর্তে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, এই অংশগ্রহণের একটা ডিমেনশন আছে, একটা অটোনমি আছে, সে জন্য সবটুকু আপসহীন এবং আপসহীনতার মধ্যে একটা তাত্ত্বিক সঙ্গতি আছে। এখান থেকে তৈরি হয়েছে আমার কমিটমেন্ট, আর এই কমিটমেন্ট বিবেকের মধ্যে বন্দি নয়, কমিটমেন্ট অনবরত তৈরি হয় সমাজ সংঘাতের মধ্য দিয়ে। আমি কখনও একা নই, সংঘাতের সম্পর্কই আমার কমিটমেন্ট তৈরি করে। সমাজের মধ্যকার সব সংঘাতে অংশগ্রহণ করে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছি, বাছাই করেছি পক্ষ এবং বিপক্ষ, আমি একইসঙ্গে ডান ও বাম হতে পারি না, একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হতে পারি না, একইসঙ্গে সামরিক স্বেচ্ছাচারের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারি না এবং সিভিল শক্তির সমর্থক হতে পারি না। আমাকে অংশগ্রহণ করতে হয় বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে, বাছাই আমার রাজনীতিকে কমিটেড করে, আমার অবস্থানের দরুন আমার পক্ষে সম্ভব হয় দুঃসময়ের দিনগুলো সাহসের সঙ্গে পেরিয়ে যাওয়ার।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমাকে বলেন, রাজনীতির আপনি কী বোঝেন; তখন আমি বলি, বলতে বাঁধ্য হই, আমার রাজনীতি আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আমি আছি বলেই আপনি আছেন। বামের স্টাবলিশমেন্ট এবং ডানের স্টাবলিশমেন্ট সবসময় চায় আমি যেন রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করি না, অংশগ্রহণ করার অর্থ নেতৃত্বের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাত শুরু হওয়া। আমার কাছে রাজনীতি হচ্ছে ইতিহাস তৈরি করে ইতিহাসে অংশগ্রহণ করা। এই অংশগ্রহণ হচ্ছে বাস্তবকে নিংড়ে একটা ফর্মে নিয়ে আসা। এই ফর্ম দরকার আমাকে বারবার সৃষ্টি করা ও আমার বিবেক জাগ্রত করার জন্য।
দেশ ব্যর্থ হয়েছে? মোটেই না। আমাদের সহ্য শক্তি, ইতিহাসের সহ্য শক্তি, শ্রমিকের-কৃষকের সহ্য শক্তি, সাধারণ মানুষের সহ্য শক্তি। এখানেই ব্যক্তির রাজনীতি যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে, আর সাধারণ মানুষ স্থায়ী বিপ্লব তৈরি করে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে। জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা ঐক্য পায়, এই ঐক্য থেকে উদ্ভূত হয় বেঁচে থাকার আন্দোলন। এই আন্দোলনের কর্মী আমি। এভাবে, জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে পৌঁছেছি ‘লাল প্রতিরোধে’, এই প্রতিরোধ একদিকে ডানের বিশ্বাসঘাতকতা উন্মোচন করেছে, অন্যদিকে বামের তাত্ত্বিক সংকীর্ণতা মেলে ধরেছে। প্রতিরোধ, শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ, আমাকে ইতিহাসে মগ্ন করেছে। এখান থেকে আমি অবস্থান নিয়েছি ডানের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে এবং বামের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এই হচ্ছে আমার এবং আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এখান থেকে জন্ম নেবে নতুন সম্ভাবনা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর : সাহিত্যিক, অধ্যাপক

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button