কামান্না ট্র্যাজেডির সাতাশ শহীদ
জাহিদ রহমান
কামান্না ট্র্যাজেডি মাগুরাবাসীর জন্য এক শোকাবহ ঘটনা। একাত্তরে, বিজয়ের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে তৎকালীন ঝিনেদা মহকুমার শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে মাধবচন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে ৪০ থেকে ৪২ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ২৬ নভেম্বর ভোররাতে ক্লান্ত-শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঘুমিয়ে তখনই আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনারা চারদিক থেকে নির্মম হামলা শুরু করে। জেগে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু ঘন কুয়াশা আর অকস্মাৎ হামলার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের মাত্র কয়েকজন অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও সাতাশজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রক্তে রঞ্জিত হয় কামান্নার মাটি।
হাজীপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুবেদার এম শমসের আলীর নেতৃত্বে এই মুক্তিযোদ্ধা দলটি বরইচারা, ফাদিলপুর গ্রাম হয়ে কুমার নদীর অপর পারে কামান্না গ্রামের মাধবচন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটিতে কমান্ডার আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বাধীন গেরিলাদের (এফএফ) বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করে। গেরিলা গ্রুপগুলো মাগুরার শালিখা থানার ধনেশ্বরগাতি ইউনিয়নের গজদূর্বা গ্রাম থেকে রওনা হয়ে কামান্নাতে যায়। মুক্তিযোদ্ধা দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল শৈলকূপায় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাক আর্মি ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর অবস্থান ও পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। উল্টো ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনী ২৬ নভেম্বর ভোররাতেই চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নেওয়া টিনের ঘরটি ঘিরে ফেলে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই ঘুমিয়েছিলেন। বিশেষ করে অনেক পথ পায়ে হেঁটে আসার কারণে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েন। আর এই ঘুমই কাল হয়ে দাঁড়ায়। পাকবাহিনী এবং রাজাকাররা চারপাশ থেকে অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধীর, আলী হোসেন, মুনিরজ্জামান এবং বেঁচে থাকার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এমএ সামাদ, এসএম রহমান, সমেশ চন্দ্র দে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কিন্তু দোতলা টিনের ঘরে সবাই আটকে পড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা দূরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রণাঙ্গন পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় পাক আর্মিরা। দ্রুতই সাতাশ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার হন। পাকবাহিনীর নির্মম হামলায় আরও শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী কামান্না গ্রামের ফণীভূষণ মজুমদার এবং রঙ্গ বিবি।
এই হত্যাকা- সমাপ্ত করে ভোরেই পাকবাহিনী জায়গা ছেড়ে চলে যায়। সকালে এই নির্মম হত্যাকা-ের খবর পেয়ে চারপাশের গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষ ছুটে আসে। তারা দ্রুত লাশগুলো উদ্ধার করে জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করেন। কামান্না হাইস্কুলের পাশেই সাতাশ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে ৬ জন করে দুটি গণকবরে এবং ৫ জন করে তিনটি গণকবরে শায়িত করা হয়।
কামান্নাতে যে সাতাশ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পাশাপাশি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সবাই একে অপরের আত্মীয়-বন্ধু অথবা পরিচিতও ছিলেন। বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন অবিবাহিত। মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার এই সাতাশ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এক সঙ্গে জীবন দান করলেও তাদের আত্মতাগের মোটেও যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। এ কারণেই অনেক শহীদ পরিবার এবং তাদের উত্তরসূরিরা চরম দরিদ্রতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেক শহীদ যোদ্ধার উত্তরসূরি সত্যিই অভাব আর অনটনে দিনযাপন করছেন। মির্জাপুরের শহীদ কাওসারের উত্তরসূরি হিসেবে আছেন বড় ভাই ইসমাইল মোল্লার মেয়ে পারুল বেগম। পারুল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা চাচাকে নিয়ে গর্বিত হলেও তাদের ভাগ্যে রাষ্ট্র থেকে কোনো সহযোগিতা আজ পর্যন্ত জোটেনি। চাচা কাওসার যে একচালা ঘরে থাকতেন সে ঘরেই থাকেন ভাতিজি পারুল। কামান্না যুদ্ধের আরেক শহীদ মোতালেবের বড় সন্তান বাবর মুন্সীরও একই অবস্থা। যুদ্ধে বাবা শহীদ হলেও তাদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি মা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করার কারণে। হৃদয়পুরের শহীদ মাছিম মিয়া, নরসিংহহাটির শহীদ সলেমান, শ্রীমন্তপুরের শহীদ মুনিরুজ্জামান, ফুলবাড়ির ওয়াহিদুজ্জামান, শিবরামপুরের শহীদ সেলিম. পারনান্দুয়ালীর শহীদ তাজুল, হাজীপুরের শহীদ গৌরের উত্তরসূরিরা কেউই কিছুই পাননি। এ নিয়ে শহীদ পরিবারগুলোর মাঝে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভের আরও কারণ রয়েছে, এই সাহসী সন্তানদের নাম সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় উঠে না আসায়। মাগুরাবাসীর অনেকেই তাদের নাম সেভাবে জানে না। মাগুরা জেলা সদরে এই সাতাশ শহীদের স্মরণে দৃশ্যমান কিছু করা হোক, যা তাদের আত্মত্যাগের কথা বলবে।