স্থানীয় সংবাদ

খুলনার ৩টি আসনে নৌকার চক্ষুশূল ঈগল ও কেটলি, দু’টি আসনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি

স্টাফ রিপোর্টারঃ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনার ছয়টি আসনের মধ্যে ৩টিতে ভোটযুদ্ধে আ’ লীগের নৌকার প্রার্থীরা আওয়ামী ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ঈগল ও কেটলির চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। খুলনা ৪, ৫ ও ৬নং আসনে নৌকার বিজয়ে বড় বাধা আওয়ামী লীগ ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা নৌকা প্রার্থীর নিকট চক্ষুশূল হয়ে দাড়িয়েছে। এতে করে শক্ত লড়াইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে ভোটাররা। তবে ৪ ও ৫নং আসনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে ভোটাররা মনে করেন।
খুলনা ৪ আসনে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী আব্দুস সালাম মুর্শেদীর সঙ্গে সাবেক হুইপ প্রয়াত এস এম মোস্তাফা রশিদী সুজার ভাই স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্তজা রশিদী দারার (কেটলি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতোমধ্যেই উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করেছে। খুলনা ৫ আসনের তিনবারের এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনের (ঈগল) লড়াইটাও জমতে শুরু করেছে। এখানে চলছে উত্তেজনকর লড়াই । এ স্বতন্ত্র দু’ জন উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। খুলনা ৬ আসনে প্রথমবারের মতো নৌকার প্রার্থী হওয়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোড়ল রশীদুজ্জামানের বিরুদ্ধেও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুর রহমান। এ আসনে রশীদুজ্জামান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী আর্থিকভাবে সবল। জানা যায়, খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুস সালাম মুর্শেদী ‘নৌকা’, জাতীয় পার্টির ফরহাদ আহমেদ ‘লাঙ্গল’, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. মোস্তাফিজুর রহমান ‘আম’, তৃণমূল বিএনপির শেখ হাবিবুর রহমান ‘সোনালি আঁশ’, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনিরা সুলতানা ‘ডাব’, ইসলামী ঐক্যজোটের রিয়াজ উদ্দীন খান ‘মিনার’, বিএনএমের প্রার্থী এস এম আজমল হোসেন ‘নোঙর’, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জুয়েল রানা ‘ট্রাক’, স্বতন্ত্র প্রার্থী এম ডি এহসানুল হক ‘সোফা’ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. রেজভী আলম ‘ঈগল’ প্রতীক পেয়েছেন। পরে উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারাকে ‘কেটলি’ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। দারা ছাড়া অন্য প্রার্থীরা সাধারণ ভোটারদের কাছে পরিচিত নয়। তাই দারাকে নিয়ে যত টেনশন মুর্শিদীর। ভোট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শিল্পপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা। রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলায় আলাদা ইমেজ রয়েছে দারার। এ ছাড়া তিনি খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। ছাত্রনেতা ও ক্রীড়াবিদ হিসেবে নির্বাচনি এলাকায় পরিচিতি রয়েছে। বড় ভাই, সাবেক হুইপ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার প্রভাবও তার পক্ষে থাকবে। তাই এ আসনে নৌকার সঙ্গে কেটলির তুমুল প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, তিনি এলাকায় উন্নয়ন করেছেন। তিনি এখানকারই মানুষ। ঘরের লোককে কেউ দূরে ঠেলে না। স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্তজা রশিদী দারা বলেন, আগে নির্বাচিত হয়ে সালাম মুর্শেদী এলাকায় আসেননি। ঢাকায় বসে থেকেছেন। আমি খুলনায় থাকি। মানুষকে সময় দিতে পারবো। এ কারণে মানুষ আমাকে ভোট দেবে। খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে আ’লীগের নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ‘নৌকা’, জাতীয় পাটির মো. শাহীদ আলম ‘লাঙ্গল’ ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ সেলিম আকতার ‘হাতুড়ি’ প্রতীক পেয়েছেন। পরে উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনকে ‘ঈগল’ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। ভোটের লড়াইয়ে শেখ আকরাম হোসেন ফিরে আসায় খুলনা-৫ আসনে নির্বাচনী উত্তাপ বেড়েছে। যা সংঘাতে রূপ নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। এক অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আনছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এতে করে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরণের সংঘর্ষ বলে ভোটাররা মনে করেন। ভোট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাবেক মন্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সঙ্গে অন্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। শেখ আকরাম হোসেন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় তুমুল লড়াই হবে এ আসনে। সহজে কেউই জিততে পারবে না।জানা গেছে, আ’লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আকরাম হোসেন এক সময় ফুলতলা উপজেলার দাপুটে জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন। ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর আওয়ামী লীগে যোগদান করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় তিনি গত ২৯ নভেম্বর স্বেচ্ছায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। খুলনা-৫ আসনের ফুলতলার একাংশ জুড়ে রয়েছে নানা শিল্প-কলকারখানা। আর ডুমুরিয়ার খ্যাতি রয়েছে কৃষিপণ্য উৎপাদনে। ডুমুরিয়ার ১৪টি ও ফুলতলার চারটিসহ মোট ১৮টি ইউনিয়ন নিয়ে খুলনা-৫ আসনের বিস্তৃতি। এর তিন দিকে রয়েছে তিন জেলার সীমানা- সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। যদিও একবার জামায়াতের হাতে যায় এ আসন। খুলনা-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, দীর্ঘকাল এলাকায় শিক্ষকতা করেছি। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে এলাকার মানুষের পাশে ছিলাম। যে কারণে মানুষ ভালোবেসে আমার পক্ষে নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন।স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেন বলেন, আমার প্রার্থীতা চূড়ান্ত হওয়ার পর উৎফুল্ল মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। মানুষ পরিবর্তন চায়। মানুষ ভোট দেওয়ার জায়গা পাচ্ছিল না। এবার ভোট দেওয়ার জায়গা পেলো।খুলনা ৬ আসনে আ’লীগ মনোনীত মো. রশীদুজ্জামান (নৌকা), জাতীয় পার্টির মো. শফিকুল ইসলাম মধু (লাঙ্গল), এনপিপি মনোনীত প্রার্থী মো. আবু সুফিয়ান (আম), বাংলাদেশ কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী মির্জা গোলাম আজম (ডাব), বিএনএম এস এম নেওয়াজ মোরশেদ (নোঙ্গর), তৃণমূল বিএনপি গাজী নাদির উদ্দিন খান (সোনালী আঁশ) ও স্বতন্ত্র হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা জিএম মাহবুবুল আলম (ঈগল) প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। জামায়াতের ঘাটি হিসেবে খ্যাত এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রশীদজ্জামান, বিএনএম প্রার্থী ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ ও স্বত্রন্ত্র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলমের প্রচার-প্রচারণা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ভোটে এ আসনে নৌকা ও ঈগলের মধ্যে লড়াই হবে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। জাপা প্রচারণায় না থাকায় নিজেদের মধ্য্ইে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ভোটাররা মনে করেন। খুলনা-৬ আসনে ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীরাই বিজয়ী হন। প্রতিবারই নতুন প্রার্থী এখানে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। ২০০৮ সালে অ্যাড, সোহরাব আলী সানা, ২০১৪ সালে অ্যাড. শেখ মো. নুরুল হক ও ২০১৮ সালে সাবেক ছাত্র নেতা মো. আক্তারুজ্জামান বাবু নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মো. রশীদুজ্জামান। তিনি এলাকায় লবণ পানির ঘেরবিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিতি। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জামানত হারান। খুলনা-৬ আসনে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ ঘরানার ইঞ্জিনিয়ার জিএম মাহবুবুল আলম। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার জি এম মাহবুবুল আলম প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় নির্বাচন জমে উঠেছে। পাশাপাশি প্রচারণায় সরব রয়েছেন বিএনএম এর নোঙ্গর প্রতীকে ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ। নেওয়াজ মোরশেদ হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত। এছাড়াও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। মো. রশীদুজ্জামান বলেন, পাইকগাছা ও কয়রার মানুষ নৌকাই বোঝে। তারা জানে উন্নয়ন মানেই নৌকা। নৌকারই জয় হবে। ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তার প্রার্থী হওয়া নিয়ে কয়রা ও পাইকগাছাবাসীর প্রত্যাশাও ছিল। বিকল্প খুঁজছিল ভোটাররা। তিনি প্রার্থী হওয়ার পর এলাকাবাসীর উচ্ছাস সেটাই প্রমাণ করে। চূড়ান্ত বিজয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button