স্থানীয় সংবাদ

ফুলতলার কুন্ডুপাড়া গ্রামের কয়েক পুরুষের পেশা কুমড়ো বড়ি বানানো

এটি এখন গ্রামের মানুষদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে

সাইফুল্লাহ তারেক, আটরা গিলাতলা প্রতিনিধি ঃ খুলনার ফুলতলা উপজেলার কুন্ডুপাড়া গ্রামের প্রায় সবার কয়েক পুরুষের পেশা কুমড়োর বড়ি বানানো। এক সময় পরিবারের প্রয়োজনে এগুলো বানানো হতো। এখন এটি গ্রামের মানুষদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কারিগরদের তথ্যমতে, এ গ্রামে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকার কুমড়ো বড়ি বিক্রি হয়। চিলান দাস বয়স এখন চলছে ৫৭। প্রতি বছর থেকে শীত এলেই তৈরি করেন কুমড়ো বড়ি। এর আগে তৈরি করেছেন তার বাবা-দাদা। এই বড়ি কারিগর বলেন, ‘শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করি। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা।’ কুমড়ো বড়ি প্রায় সকল মানুষের জনপ্রিয় খাবার। মাষকলাই ও চাল কুমড়া দিয়ে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি। মূলত শীতকালেই এটি তৈরি ও খাওয়ার চল বেশি।গ্রামের কালবতি চন্দ্র বলেন, ‘এ গ্রামে প্রায় ৬৫ ঘর কুমড়ো বড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেক বাড়ি প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কেজি বড়ি তৈরি করে। আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বড়ি তৈরি। চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত। আমরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এই বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে থাকি।’তিনি আরও বলেন, ‘যখন ৫ কেজি মাষকালাইয়ের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা ছিল, তখন থেকে আমি বড়ি তৈরি করছি। আমি যেমন বাবার হাত ধরে এ পেশায় এসেছি। আমাদের সন্তানেরাও তেমনি কুমড়ো বড়ি তৈরির হাল ধরবে।’খুলনা শহর থেকে উত্তরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত কুন্ডুপাড়া গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ নারী-পুরুষ সনাতন ধর্মের। শীতকালের সময়টায় গ্রামের প্রবেশমুখ থেকেই চোখে পড়ে চাটাইয়ের ওপর সারি করে বিছানো সাদা মাষকলাইয়ের তৈরি কুমড়া বড়ি। গ্রামের ভিতরে গৃহিণীরা বাড়ির ছাদে একত্রে দল বেঁধে বা কেউ কেউ মাটিতে মাদুর পেতে বড়ি তৈরির কাজ করছেন।এ কাজে নারীদের হাতের ছোঁয়াই বেশি। তবে বাড়ির পুরুষদের ভূমিকা কম নয়। তারা যাতায় কালাই পেষেন। বড়িও বানান। তাদের সাথে হাত মিলিয়ে ছোটরাও শিখে নেয় বড়ি তৈরি। অনেকের বাড়িতে মেশিনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে কুমড়ো বড়ি।বড়ি তৈরির প্রক্রিয়া জানান সাবলা গ্রামের গৃহবধূ অর্মিলা অন্তরা। শীতের এই মৌসুমে প্রতিদিন রাত ২টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত তারা বড়ি বানানোর কাজ করেন।অর্মিলা অন্তরা জানান, প্রথমে মাসকলাই রৌদ্রে শুকিয়ে যাতায় ভেঙ্গে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। পরে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা মাষকলাই পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ঢেঁকি বা শিল-পাটায় কুমড়ো বেটে নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর কলাই ও চাল কুমড়া দুইটির মিশ্রণে বানানো হয় বড়ির উপকরণ।এরপর বড়িগুলো পাতলা কাপড়ে সারি করে বাঁশের মাচাঙে রেখে রোদে শুকানো হয়। এতে সময় লাগে অন্তত তিন দিন। অনেকে বড়িকে শক্ত করার জন্য অল্প পরিমাণে আলো চালের আটা মেশায়।গ্রামের আরেক নারী কারিগর জোসনা বলেন । তার বাড়ি কেরানীগজ্ঞে। কিন্তু প্রায় সাত বছর আগে কুন্ডুপাড়া গ্রামে বিয়ের সুবাদে কুমড়ো বড়ি তৈরি করা শেখেন। জানালেন, দৈনিক ১০ থেকে ১২ কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে পারেন তারা।অন্য সব ব্যবসার মতো এতেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে বলে জানান জোসনার স্বামী খোকন কান্ত। গত মৌসুমে প্রায় আড়াই লাখ টাকার বড়ি বিক্রয় করেছিলেন তিনি। তিনি জানান, গত বছর ৫০ কেজির মাষকলাইয়ের বস্তার দাম ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এ বছর তিনি তা কিনেছেন ৫ হাজার ৭০০ টাকায়। এ কারণে এবার কুমড়ো বড়ির দাম বাড়ানো হয়েছে।কারিগররা জানান, প্রত্যেক ঘরে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কেজি কমুড়ো বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন তারা।দুই ধরনের কুমড়ো বড়ি তৈরি হয়। একটি সাধারণ মানের। আর ভালোটি শুধু মাষকলাই দিয়ে তৈরি, দামও বেশি। সাধারণ বড়ি পাইকারি হারে প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২২০ টাকায় এবং ভালোটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। খুচরা হিসেবে ভালো মানেরটি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।ঐতিহ্যের গ্রামের বাসিন্দারা কয়েক বছর আগেও বেশ অভাবে ছিলেন। কিন্তু এখন তাদের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।নিজেদের জীবন মানের উন্নতির কথা বললেন আরেক ষাটোর্ধ কারিগর শ্যামল কুমার মোহন্ত। তিনি বলেন, ‘এ গ্রামের কুমড়োর বড়ি তৈরির ইতিহাস প্রায় একশ বছরের বেশি। এখানকার বড়ির চাহিদা দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে।’তিনি আরও বলেন, ‘এখন এটি আর মৌসুমি ব্যবসা নয়। নিয়মিত ব্যবসা হয়ে উঠছে। ফলে এখানকার মানুষের জীবনমানও উন্নত হচ্ছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে।’ফুলতলা বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী কামরুল মিয়া বলেন সাত বছর ধরে কুমড়ো বড়ি ব্যবসা করছি।, ‘প্রতি সপ্তাহে গ্রাম থেকে ১ থেকে দেড় মণ বড়ি কিনি। এখানকার বড়ির মান ভালো। প্রতি বছর আমার দোকানে বিপুল পরিমানে কুমড়ো বড়ি বিক্রি হয়। এ ছাড়া ঢাকা সহ সরাদেশে পাইকাররাও আসে এই কুমড়া বড়ি কিনার জন্য।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button