স্থানীয় সংবাদ

খুমেক হাসপাতালে সরকারি ওষুধ সিন্ডিকেটের পেটে : রোগীর ভাগ্যে জোটে যৎসামান্য

খুমেক হাসপাতালে অনিয়ম-অবহেলা চরমে, দেখার কেউ নেই (পর্ব-৫)

বিনামূল্যে কোন ওষুধ পাওয়া যাবে জানেন না রোগী

কামরুল হোসেন মনি ঃ খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে বেশিরভাগ মানুষ হতদরিদ্র এবং দিনমজুর। এসব গরিব মানুষেরা রোগে আক্রান্ত হলে তাদের একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতাল। তবে ভরসার সেই হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না সরকারি ওষুধ। বিনামূল্যে মিলে কোন ওষুধ জানেন না রোগীরা। চিকিৎসকরা রোগনির্ণয় করে অসহায় রোগীদের ধরিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন কোম্পানির দামি ওষুধের প্রেসক্রিপশন। যা কিনে খাওয়ার সক্ষমতা অনেকের নেই। সরকারি ওষুধ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে অসহায় রোগীদের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ইউনিট-২ তে চলতি মাসে জানুুয়ারি মাসে ভর্তি হন প্রদীপ সরকার (৪৮)। তার মেয়ে জয়ন্ত্রী জানান, তার বাবাকে নিয়ে তাদের ৮-১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। সেখানে চিকিৎসক তাকে ওমিপ্রাজল-৪০ ইনজেকশন লিখে দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন তাকে একটি করে ইনজেকশন দেয়ার কথা। সরকারিভাবে এই ইনজেকশন বরাদ্দ থাকলেও ৮টি ইনজেকশন ১ হাজার ২শ’ টাকা দিয়ে তাদের বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। এমনকি জ¦রের ট্যাবলেট, গ্যাসের ট্যাবলেটও বাইরে থেকে কেনা লাগছে। তার মতো অনেক ভুক্তভোগী রোগীরা একই অভিযোগ করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য বলছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ পান এবং ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয় এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড: মো. নুরুল আমিন ‘রোগীর নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে জানান, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের প্রধান উৎস হলো ওষুধ। এই খাতে ব্যয় প্রায় ৬৪ ভাগ। হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার মাধ্যমে যথাক্রমে ১২ ও ১১ ভাগ ব্যয় হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ ওষুধ দেয়া হয় না এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধের পাশাপাশি স্যালাইন, ইনজেকশন, সিরাপ, ড্রপ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, স্যাভলন, হেক্সিসল প্রভৃতি দেয়ার কথা। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে সরকারিভাবে ৭২ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশনও আছে ; যেগুলো রোগী বিনামূল্যে পেতে পারেন। এখন প্রশ্ন, কোন কোন ওষুধ হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়- সেই তথ্য সাধারণ রোগীরা জানবেন কীভাবে? যদি হাসপাতাল থেকে ওষুধ সরবরাহ করাই হয় তাহলে সেগুলো সাধারণ রোগীরা পায় না কেন? খুমেক হাসপাতালের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে থেকে জানা যায়, হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সামগ্রীসহ ওষুধ বাইরে পাচার হচ্ছে। এই পাচারে সক্রিয় একাধিক সিন্ডিকেট। হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নার্স, ট্রলিম্যান, ওয়ার্ডবয়, ফার্মাসিস্ট এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের অংশ। আর এই কাজটি ৩টি স্তরে হয়ে থাকে। হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রথমে এসব ওষুধ দালালদের কাছে বিক্রি করে। দালালদের হাত ঘুরে চলে যায় বিভিন্ন ওষুধের দোকানে। পরে চড়া মূল্যে বিক্রি হয় ভোক্তাদের কাছে। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সরবরাহ করা এসব ওষুধ পাওয়া যায় খুলনা শহরের হেরাজ মার্কেটসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন ফার্মেসিতে। ওষুধের গায়ে সরকারি মনোগ্রামে ‘বিক্রি নিষেধ’ লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে চড়া মূল্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বেশ কিছু সিন্ডিকেট সদস্য ধরাও পড়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একাধিকবার সরকারি ওষুধ পাচার করার সময় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আটক করেছিলো। মূলহোতাকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে এ ব্যাপারে শোকজ করা হয়েছিলো। পরে অদৃশ্য কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ব্যাপারে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মো: হুসাইন শাফায়াত বলেন, আমাদের হাসপাতালটি ৫০০ শয্যা। কিন্তু রোগী প্রায়ই ১২০০-১৫০০ রোগী ভর্তি থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর চাপের কারণে ওষুধ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ওয়ার্ডে ওষুধ সাপ্লাই থাকার সত্বেও কোন রোগীকে না দেওয়া হয়। এমন কোন অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button