খুমেক হাসপাতালে জখমি সনদপত্র বাণিজ্য নয়া কৌশল এমসি শাখার রফিকের
খুমেক হাসপাতালে অনিয়ম-অবহেলা চরমে, দেখার কেউ নেই-৮

‘৬০০ টাকা দিছি, তারপরেও একমাস ধরে ঘুরছি’
ভিকটিমের জখমি সনদের জন্য তিন বার আবেদন করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা
কামরুল হোসেন মনি ঃ সাধারণত রোগীকে যখন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয় তখন তাকে একটি ছাড়পত্র (ফরংপযধৎমব পবৎঃরভরপধঃব) দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা বাংলাদেশ ফরম নং-৮১৭তে এটি লিখে থাকেন। এতে রোগীর নাম, বয়স, পিতা/স্বামী, ঠিকানা, হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ওয়ার্ড, বেড নং, চিকিৎসার সময়কাল এবং রোগের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তারিখসহ স্বাক্ষর প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, রোগীর কী সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে কী অবস্থা পাওয়া গেছে, কি কি টেস্ট করানো হয়েছে এবং সেগুলোর ফলাফল কী, অপারেশন হয়ে থাকলে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, কি কি ওষুধ কত দিন যাবত সেবন করবেন এবং পরবর্তী সময়ে কতদিন পর জখমের সেলাই কাটতে হবে বা হাসপাতালে আসতে হবে- এই বিষয়গুলোও লিপিবদ্ধ থাকে। এজন্য এই ছাড়পত্রটি শুধু রোগীর চিকিৎসার জন্য নয়, আইনগত সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই সনদপত্র নিতে এসে এক মাস ধরে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে ঘুরছেন ভুক্তভোগী তৈয়ব। তার চাচীসহ তিন জনের জখমি সনদ নিতে হাসপাতালে এমসি শাখায় অফিস সহকারি মো: রফিকের কাছে আসেন। সাথে ছিলো ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদপত্র সরবরাহের আবেদন কপি সংশ্লিষ্ট থানার। তারপরেও নানা তাল-বাহানা শুরু করেন ওই রফিক। এরপর রফিককে ৬০০ টাকা দেন তৈয়ব। তারপরেও বলেন, ১০-১২ দিন পর আসেন। ওই সময়ে এসেও তাকে নানা অজুহাতে দেখিয়ে রফিক বলেন, সময় লাগবে। ভুক্তভোগীর এই অভিযোগসহ এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
ভুক্তভোগী মো: তৈয়ব বলেন, ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদপত্র সরবরাহের আবেদনটি (সংশ্লিষ্ট থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সরবারকৃত) নিয়ে প্রায় একমাস ধরে ঘুরছেন। ওই রফিককে ৬০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। তারপরেও বলে পাঠায় দিছি। আমি সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাকে ফোন দিলে সে বলে এখনও পায়নি।
বাগেরহাটে মোড়লগঞ্জে থানার মামলা নং-৩০, তারিখ-২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩; জিআর নং-৩৬৫, তারিখ ২৯ ডিসেম্বও, ২০২৩; সময় ২০.৫০ ঘটিকা, ধারা : ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৭৯/৩৫৪/১১৪/৫০৬, পেনাল কোড ১৮৬০। এই যে সূত্র বর্ণিত মামলার নি¤œবর্নিত ভিকটিম এই মামলার আসামীগণ কর্তৃত গত ২৫-১২-২০২৩ জখম প্রাপ্ত হয়ে ২৭-১২-২০২৩ থেকে ০২-০১-২০২৪ পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। মামলা ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে উল্লিখিত ভিকটিমের জখমি সনদ সরবরাহের জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করা হলো। ভিকটিমরা হচ্ছে মৃত. নওয়াব আলী শেখের পুত্র মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম (৬৩), মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের স্ত্রী মিনারা বেগম (৫১) এবং মোহাম্মদ নুরুল ইসলমের কন্যা মাকুলী। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানার পাঠামারা গ্রামের বাসিন্দা। মোড়লগঞ্জ থানা এসআই কেএম নাসির উদ্দিনের স্বাক্ষর রয়েছে।
এব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপ-পরিচালক ডা: মো” হুসাইন শাফায়াত বলেন, ‘এরকম কয়েকটি অভিযোগ আসছে আমার কাছে। আমি বিষয়টি খতিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করবো। ’
এ ব্যাপারে মোড়লগঞ্জ থানার এসআই ( নিরস্ত্র) কে এম নাসির উদ্দিন শুক্রবার রাত পৌনে ৮টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, এই পর্যন্ত তিন বার আবেদন করেছি জখমি সনদপত্র পাওয়ার জন্য। কয়েক মাস হয়ে গেলেও তাও পাচ্ছি না। তিনি বলেন, হাসপাতালের এমসি শাখায় রফিকের সাথে ( গতকাল) কথাও বলছি, সে বলে পেয়ে যাবেন। ওই পুলিশ কমর্কর্তা বলেন, এটা হয়রানী ছাড়া কিছুই না, পাবো তার কোন ঠিক নেই। রফিক বলে দু-একদিন লাগবে। এ ব্যাপারে খুমেক হাসপাতালের এমসি শাখার অফিস সহকারি মো: রফিককে তার মুঠো ফোনে ফোন দিলে তার ছেলে বলে তিনি বাসায় নেই। জানা গেছে, একটা সময় ছিল যখন জখমিকে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক তাকে মেডিকেল সার্টিফিকেট (এমসি) প্রদান করতেন। এটার কিছু ভালো দিক থাকলেও অনেকে এটার অপব্যবহার করেছিল। ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একাধিক পরিপত্রের মাধ্যমে নির্দেশনা দেন যে, কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্র ব্যতীত এবং ৩ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক জখমির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা ব্যতীত কোনোক্রমেই এমসি প্রদান করা যাবে না। তবে পুলিশ রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার কোনো নারী ও শিশুর ক্ষেত্রে এমসি প্রদান করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। এভাবে মামলা দায়েরের পর আদালত বা তদন্তকারী সংস্থার এরূপ চাহিদাপত্র প্রাপ্তি, জখমির জন্য বোর্ড গঠন ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, এমসিসহ ফরোয়ার্ডিং প্রস্তুতকরণ এবং তা ডাকযোগে প্রেরণ ইত্যাদি নিয়মাবলি মেনে চলতে দীর্ঘ সময় কেটে যায়। অধিকাংশ মামলার এজাহার বা নালিশে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে যে অতিরঞ্জিত বক্তব্য থাকে তা শুরুতেই প্রাথমিকভাবে সত্যতা নিরূপণের জন্য এমন একটা মেডিকো-লিগ্যাল রিপোর্ট আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি সরকার দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল তথ্যভান্ডার চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এই ইলেকট্রনিক ডেটা যে কোনো সময় সমস্ত হাসপাতাল থেকে দেখা ও সংগ্রহ করা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ এই ডাটাবেজে ইনজুরি নোট সংযোজন করা হলে নিঃসন্দেহে মেডিকো-লিগ্যাল সেবায় আরও স্বচ্ছতা ও গুণগত মান বাড়বে।