স্থানীয় সংবাদ

বানিয়াখামার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ

বাঁধা হওয়ায় প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত, ন্যায় বিচার দাবি প্রধান শিক্ষকের

স্টাফ রিপোর্টার ঃ খুলনা মহানগরীর পশ্চিম বানিয়াখামার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ প্রতিষ্ঠানটিতে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিটির রেজুলেশন খাতাসহ প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বাড়িতে নিয়ে তিনি নিজেই মনমত তৈরি করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের খুব একটা ভূমিকা রাখতে না পারলেও ইচ্ছামত বিল-ভাউচার তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের অর্থ গ্রহণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবী’র সুবাদে দীর্ঘ টানা আট বছর ধরে স্কুলের সভাপতির পদ দখলে রেখে তিনি অনেকটাই স্বেচ্ছাচারি ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। সঙ্গে কমিটিতে তার অনুগত কতিপয় সদস্য মদদ জোগান। ফলে স্কুলের সকল শিক্ষক-কর্মচারিকে সভাপতির ইচ্ছামাফিক-ই চলতে হয়। এমনকি চাকরির ভয়ে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতেও চান না। তবে সভাপতি তার বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের করা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এদিকে, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজের নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ডে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ রবিউল ইসলাম নিজেই এখন হুমকির মুখে রয়েছেন। বিভিন্ন হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং দফায় দফায় কারণ দর্শানো নোটিশ, এমনকি মামলা করেও প্রধান শিক্ষককে নিজের বশে আনতে না পেরে সর্বশেষ বিধি বহির্ভূতভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিকার ও ন্যায় বিচার চেয়ে প্রধান শিক্ষক যশোর শিক্ষা বোর্ড এবং খুলনা জেলা প্রশাসক ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত আবেদন করেছেন। প্রধান শিক্ষক মোঃ রবিউল ইসলামের অভিযোগ, বিদ্যালয়ের আগামী মেয়াদে ম্যানেজিং কমিটিতে সভাপতি তার পছন্দ সই অভিভাবক সদস্য ও শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত করে পুণরায় নিজেকে সভাপতি নির্বাচিত করা এবং তার এক আত্মীয়কে বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। এ বিষয়ে বাঁধা মনে করে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার জন্য ২৪ ডিসেম্বর ও ৩০ জানুয়ারি আলাদা দু’টি কারণ দর্শানো নোটিশের আলোকে ২০ ফেব্রুয়ারি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে স্মারক বিহীন একটি পত্রের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেন।
যশোর শিক্ষা বোর্ড এবং জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত অভিযোগে মোঃ রবিউল ইসলাম উল্লেখ করেন, তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ বানিয়াখামার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের কিছুদিন পর জানতে পারেন বিদ্যালয়ে যাবতীয় আয়ের ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক রেকর্ড না থাকলেও ব্যয়ের রেকর্ড আছে, অর্থাৎ ছাত্র বেতন আদায় করা হয় বিনা রশিদে। তখন তিনি বেদন আদায়ে রশিদ ব্যবহার করার উদ্যোগ নিলে কমিটি এবং কতিপয় শিক্ষক-কর্মচারী তার উপর ক্ষিপ্ত হতে শুরু করেন। যার সূত্র ধরে বিভিন্ন সময়ে তাকে ফোনে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করা হয়। ওই ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি ২০১৯ সালের ৩ আগষ্ট সোনাডাংগা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সাধারণ ডায়রি করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ কমিটির অভিভাবক সদস্য মো. জহুরুল ইসলাম মোল্লাকে দিয়ে গত বছরের ৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে খুলনার মহানগর হাকিমের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করে অভিযোগের কোন সত্যতা নেই- মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো. নাজমুল হুসাইন গত ১ জুন আদালতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। অভিযোগে প্রধান শিক্ষক আরও উল্লেখ করেন, মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসাতে না পেরে এবং বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের বিভিন্ন প্রকারের খরচ বাবদ নামে-বেনামে বিভিন্ন ভাউচার তৈরীতে সমস্যা মনে করে সভাপতি প্রতিনিয়ত তাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি করছেন। যার অংশ হিসেবে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের হয়রানিমূলক মিথ্যা অভিযোগ তৈরীর জন্য উদ্দেশ্যমূলক এবং বিধি বহির্ভূতভাবে বিদ্যালয়ের রেজ্যুলেশন ও নোটিশ খাতা অফিসনোটসহ গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড পত্র সভাপতি দীর্ঘদিন যাবত নিজের কাছে রেখে দেন। ফলে কমিটির সভা আহবানের তারিখ, সময় ও আলোচ্য সূচীও তিনি এককভাবে নির্ধারণ করে থাকেন। এমনকি স্কুলের অফিস সহকারী থাকা সত্বেও একজন অনুগত বিদ্যোৎসাহী সদস্যকে দিয়ে তিনি বাসায় বসেন রেজুলেশন লেখান। তার এ ধরনের বহির্ভূত কর্মকান্ডে বিরুদ্ধে তদন্ত চেয়ে প্রধান শিক্ষক গত ১২ ফেব্রুয়ারি যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং খুলনা জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। এছাড়াও কমিটির একজন অভিভাবক সদস্য ও সহকারী শিক্ষককে দিয়ে সভাপতি তাকে শরিরীকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি বিদ্যালয়র শিক্ষক-কর্মচারীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা লিখিত অভিযোগ দিতে বাধ্য করেছেন বলেও অভিযোগ করেন প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনায়ও তিনি গত ১০ ফেব্রুয়ারি সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় বিগত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এমনকি বিগত ১৮ মাস ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বিদ্যালয় প্রদত্ত বেতন-ভাতা তিনি তার একক সিদ্ধান্তে বকেয়া রেখেছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতাদি না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের ছল চাতুরির আশ্রয়ও তিনি গ্রহণ করছেন। প্রধান শিক্ষক মোঃ রবিউল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, সভাপতি হিসেবে শেখ আব্দুল আজিজ বিগত ৮ বছর দায়িত্ব পালন করলেও তার অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে বিদ্যালয়ে কোন উন্নয়ন করতে পারেননি। ফলে পুরাতন জরাজীর্ণ বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনটিতে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষার অনুকূল পরিবেশও তৈরি করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়টিতে নিরাপদ পানির সুবিধা, টয়লেট, বিজ্ঞানাগার, আইসিটি ল্যাব ও গ্রন্থাগার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির এ সকল বিষয়ে ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও এসব সমস্যা সমাধানে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আর এ সকল ব্যর্থতা আড়াল করতে সভাপতি মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিতে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন, এমনকি তিনি তাদের মধ্যে গ্রুপিংও সৃষ্টি করে থাকেন বলেও অভিযোগ করেন প্রধান শিক্ষক। তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অভিযোগ অস্বীকার করে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রধান শিক্ষকের সাময়িক বরখাস্ত বিধি বহির্ভূত হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারেন। তবে প্রধান শিক্ষক সংশোধন হলে কমিটির ক্ষমতা অনুযায়ী ৫৯দিন পর সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করে তাকে যোগদান করানো যেতে পারে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিভাবক সদস্যের দায়েরকৃত মামলায় পিবিআই’র তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, বাদি’র নারাজির প্রেক্ষিতে আদালত রিপোর্টটি বাতিল করে অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া রেজুলেশন খাতা নিজের বাসায় নয়, বরং প্রধান শিক্ষক কর্তৃক টেম্পারিং ও এজেন্ডা অন্তর্ভূতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার তত্বাবধায়নে অফিস সহকারী বিকাশ চন্দ্রে’র আলমারিতে রাখা হয় বলেও স্বীকার করেন সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার ফারহানা নাজ বলেন, পশ্চিম বানিয়াখামার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বিধি বহির্ভূতভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে- মর্মে একটি আবেদনের বিষয়ে তিনি অবহিত আছেন। বিষয়টি তদন্ত করে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button