মহান স্বাধীনতা দিবস আজ

নগরীতে শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধায় দিনব্যাপী পালিত হবে নানা কর্মসূচি
মোঃ আশিকুর রহমান ঃ বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার গর্বের দিন ২৬শে মার্চ, আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। হাজার বছরের সংগ্রাম মুখর বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের এই দিনে কাংক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে। ঐতিহাসিক দিনটির তেপান্ন বছর পূর্ণ হলো । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর জেঁকে বসে নতুন জান্তা।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়; ভৌগলিক বিছিন্নতা, ভাষা ও সংস্কৃতির কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলাকে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই রাষ্ট্রটির যাত্রার শুরুতেই পূর্ব বাংলার মানুষ অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন দিক থেকে বৈষমের স্বীকার হয়। তবে এই পরিস্থিতি তখন থেকেই মেনে নেয়নি এ ভূ-খ-ের মানুষ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র, কৃষক শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদে নামে, আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। দ্রুতই এই আন্দোলন সংগ্রামগুলো একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগ্রামে রূপ নিতে থাকে, যা স্বাধীন ও মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হয়ে রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আর বাঙালির এই আন্দোলন-সংগ্রামকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তানের শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতি শুরু থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামে। পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুন্থান, ’৭০-এর নির্বাচনসহ দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতি ১৯৭১ সালে এসে উপনীত হয়। পাকিস্তানের সামরিক, স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। আর বাঙালির এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের এক পর্যায়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স) বক্তব্যে বাঙালির মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে।
অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা বার্তা লিখে যান- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’ বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা প্রথমে ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এই বার্তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কাছে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভমহানির বিনিময়ে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্য সারা দেশের মতো নগরীর খুলনাতেও সরকারি, বেসকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন সংগঠন সমূহ স্বাধীনতার মহান স্থাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও শহীদ পরিবার সহ বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে আত্ম উৎস্বর্গকারী শহীদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধায় বিভিন্ন কর্মসূচির পালন করবে। খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্য জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খুলনার গল্লামারী সৃত্মিসৌধে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে পুষ্পমাল্য অর্পন, সকাল ৮টায় জাতীয় সংগীতের সাথে কর্মসূচির উদ্বোধনী, জেলা স্টেডিয়ামে কুজকাওয়াজ, একই সাথে শিশু সমাবেশ, দেশত্ববোধক গান ও কবিতা আবৃতি এবং পুরষ্কার বিতরনী, বিকাল সাড়ে ৩টায় শিল্পকলা একাডেমীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বর্ধনা প্রদান ও দোয়া অনুষ্ঠান। সূর্যোদয়ে সাথে সাথে খুলনা মেট্রো পলিটন পুলিশ লাইনে একত্রিশবার তোপধ্বনি মাধ্যমে দিবসের শুভ সূচনা করা হবে। দেশ ও জাতির শান্তি, অগ্রগতি কামনা করে বাদ যোহর বা সুবিধা জনক সময়ে সমজিদ দোয়া এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। সুবিধা জনক সময়ে (ইফতার ও সেহেরী) হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা ও শিশু পরিবারসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা। ২৬ মার্চ সুবিধাজনক সময়ে হাদিস পার্কে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং প্রামান্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং খুলনার সকল পার্ক, জাদুঘর, গনহত্যা জাদুঘর, শিশুদের জন্য বিনা টিকিটে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত উম্মুক্ত রাখা হবে। ওই দিন উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরীতে মুক্তিযোদ্ধাভিত্তিক দুর্লভ ছবি ও পুস্তক প্রদর্শন করা হবে। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে কেসিসি’র পক্ষ হতে দিবসের প্রত্যুষে গল্লামারী স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নগর ভবন, মেয়র ভবন, খালিশপুর শাখা অফিস, স্বাস্থ্যভবন, সকল ওয়ার্ড অফিস, কমিউনিটি সেন্টারসহ কেসিসি পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, নগর ভবন, নগরীর সড়ক দ্বীপ ও ৩টি প্রবেশদ্বারে কাগজের পতাকা দ্বারা সুসজ্জিতকরণ এবং নগর ভবন, খালিশপুর শাখা অফিস, মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য, পাবলিক হল চত্ত্বর ও শহীদ হাদিস পার্কের কৃত্রিম পাহাড়ে আলোক দ্বারা সজ্জিত করণ এবং সকাল পোনে ৭ টায় নগর ভবনে বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়া সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নগরীর ওয়ান্ডারল্যান্ড শিশুপার্ক ও লিনিয়ার পার্কে শিশুদের বিনামূল্যে প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হবে।
খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে নানা কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচির অংশ হিসাবে ২৬ মার্চ, মঙ্গলবার
সকল ৬টায় শহিদ তাজউদ্দিন আহমদ ভবনের সম্মুখে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, র্যালিসহকারে অদম্য বাংলায় শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন, শ্রদ্ধাঞ্জলির পর সাংবাদিক লিয়াকত আলী মিলনায়তনে আলোচনা সভা, অদম্য বাংলার সম্মুখে দিনব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বাদ যোহর কেন্দ্রীয় মসজিদ ও প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল, সকাল ৯টায় মন্দিরে প্রার্থনা।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে খুলনা মহানগর আ’লীগের পক্ষ হতে নানা কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচির কর্মসূচির অংশ হিসাবে ২৬ মার্চ, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় ৬টায় গল্লামারী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, সকাল ৯টায় দলীয় কার্য্যালয় হতে র্যালী বের হবে এবং র্যালি শেষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে খুলনা বিএনপি’র কর্মসূচি অংশ হিসাবে ২৬ মার্চ সর্যোদ্বয়ের সাথে সাথে সকল দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৬টায় গল্লামারী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বেলা ২টায় দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলাম বন্দ জানান, বাঙ্গালী জাতির আত্মত্যাগ আর গৌরবজ্বল মাস অগ্নিঝরা মার্চ। আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে নেতৃত্বে পাকিস্তানী দোসরদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করেছি। জাতি হারিয়েছে অনেক সম্ভাবণা। মা-বনেরা হারিয়ে তাদের সর্বস্ব। মহান স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদের প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি তাদের আত্মত্যাগের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
মুক্তিযোদ্ধা সন্তান শেখ নিয়াজ আহমেদ জানান, আমার বাবা শেখ ওবায়দুল্লাহ রনো বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাবা আজ বেঁচে নেই। তিনি এই দেশের স্বাধীনতা জন্য লড়াই করেছেন, পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছেন আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। আজ বাবা নেই, কিন্তু বাবার রেখে যাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ আছে। বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের ভু-খন্ডে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন একটি দেশ, প্রিয় বাংলাদেশ।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন জানান, যথাযোগ্য মর্যদায় মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নানা কর্মসুচি হাতে নেওয়া হয়েছে। খুলনার গল্লামারী সৃত্মিসৌধে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে পুষ্পমাল্য অর্পন, জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে জেলা স্টেডিয়ামে কর্মসূচির উদ্বোধন, কুজকাওয়াজ, শিশু সমাবেশ, দেশত্ববোধক গান ও কবিতা আবৃতি এবং পুরষ্কার বিতরনী, শিল্পকলা একাডেমীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বর্ধনা প্রদান ও দোয়াসহ নানা কর্মসূচি পালিত হবে। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, বাঙালি জাতির পরাধিনতার সিকল হতে মুক্তিাদাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই বাংলাদেশ সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার পথে এগিয়ে যাবেই বাংলাদেশ