স্থানীয় সংবাদ

ভান্ডারকোর্ট ইউপি চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছচারিতা চরমে

নোনা পানির কারণে চাষাবাদ বন্ধ

শতাধিক ভূমিহীন পরিবারের কান্না দেখার কেউ নেই, গরিবের আশ্রয়ন প্রকল্পে নির্মিত বাড়ি ঘরের টিন পর্যন্ত নিয়ে গেছে চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ

আনিছুর রহমান কবির ঃ বটিয়াঘাটার ভান্ডারকোট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ
এরচেচ্ছাচারিতা ও এক ক্ষমতা বলে শতাধিক অসহায় ভূমিহীন পরিবারকে জিম্মি করে নোনা পানি উত্তোলন করে মাছ চাষ করায়। ভূমিহীনদের প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি জবর দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপুল পরিমান এ জমির মধ্যে প্রায় তিনশ’ বিঘা জমি ভূমিহীনদের এবং বাকি প্রায় ১২শ’ বিঘা জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। প্রকৃত জমির মালিকরা বিগত দুই বছর ধরেই নিজেদের জমিতে যেতে পারছে না। এ নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ থানায় অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। প্রত্যন্ত এলাকার এসব গরিব অসহায় মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুধু জমি জবর দখল নয় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রাতের আধাঁরে অসহায় মানুষ গুলোকে অস্ত্র, সন্ত্রাসী বাহিনী ও হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে রেখেছেন বলে ভুক্তভোগিদের অভিযোগ। বটিয়াঘাটা উপজেলার ভান্ডারকোট ইউনিয়নের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে হালিয়া গ্রাম। কাজিবাছা নদীর তীর ঘেষে গড়ে ওঠা গ্রামটিতে মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস কৃষি কাজ। বর্ষায় ধান চাষ করেই সারা বছরের খোরাকি জমা করে তারা। গ্রামটিতে রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। চার কিলোমিটার দুর থেকে পানি সংগ্রহ করেই তাদের চাহিদা মেটাতে হয়। লবন পানির ঘেরের কারণে শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা লালচে বর্ণ ধারণ করে পুরো গ্রাম। দেখলে ধুধু মরুভূমির মতই মনে হয়। অথচ পার্শ্ববর্তি মাইটভাঙা বরণপাড়া গ্রামটি সবুজে ভরপুর। সেখানে বারোমাস চাষাবাদের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক সুদিন ফিরেছে। গ্রাম দুটি পাশাপাশি হলেও চিত্র ভিন্ন। হালিয়া গ্রামের পরিণতি হয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যানের দখলদারিত্বে লবনপানি উঠিয়ে মাছ চাষের কারণে। গত কয়েকবছর ধরেই দুর্বিষহ জীবন যাপনে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে মানুষ। রাস্তা ঘাটের অবস্থা আরো খারাপ। উপজেলা সদরে যেতে বিশাল কাজিবাছা নদী পার হতে হয় মানুষের। রাস্তা থেকে হাটু কাদা ভেঙে তবেই উঠতে হয় ইঞ্জিন চালিত নৌকায়। গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি সেখানে একটি ঘাট নির্মান। তবে চেয়ারম্যানের সে বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেই। অথচ এই গ্রামের প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমিতে ঘের করে বছরে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করছে বলে দাবি করেছে গ্রামবাসী।
স্থানীয়রা জানায়, এই গ্রামের প্রায় একশ ভুমিহীন মানুষের জন্য ২০১১-১২ সালে ৭৫ একর জমি লিখে দেয় সরকার। সেই সময় থেকে তারা উক্ত জমি ভোগ দখল করে আসছিলো। এরমধ্যে খুলনা শহরের প্রভাবশালী বাসিন্দা হোসেন ইমাম চৌধুরী পল্টু নামে এক ব্যক্তি জোর করে ওই জমি দখলে রেখেছিলো। বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ভূমিহীন জমি মালিকদের নিয়ে উক্ত প্রভাবশালী হোসেন ইমাম চৌধুরী পল্টুকে উচ্ছেদ করে দেয়। এই উচ্ছেদের পর জমি মালিকরা জমিতে ঘের ও চাষাবাদ করতে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ। চেয়ারম্যান নিজেই উক্ত জমি জোর করে দখলে নেয়। গত দুই বছর ধরে ওই জমিতে ভুমিহীনদের প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ। তিনি লবন পানি তুলে ঘেরের মাধ্যমে মৎস্য চাষ করছেন। জমি দখলের বিষয় নিয়ে হালিয়া বরুনপাড়া ভূমিহীন সমবায় সমিতির সভাপতি মনোরঞ্জন চৌকিদার ও সম্পাদক শুধাংশু শেখর ঢালী বলেন, আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের নানা সমস্যা নিয়ে চেয়ারম্যানের গিয়ে কোন প্রতিকার পাই না। এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়ন হয় না। পানির কষ্টে ভুগতে হয় মানুষকে। নদী পারাপারের সুবিধা দেয়া হয় না। অথচ গরিবের জমি জোর করে দখল করে নিয়ে পথে বসিয়ে দিয়েছে।
গ্রামের অপরপ্রান্তে গোগের খাল নামে ১১ একরের আরো একটি খাল রয়েছে। সেই খালের বন্দোবস্ত নেয় স্থানীয় লক্ষীখোলা সমবায় সমিতি। সমিতির নামে খাল বন্দোবস্ত নেওয়া হলেও খালটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় সমিতির লোকজন। এই খালকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ১২শ বিঘা জমি চাষাবাদ হয়। যা এই খালের পানির ওপর নির্ভরশীল। চেয়ারম্যান তার লোকজন নিয়ে উক্ত খালটিও দখল করে নেয়। খালসহ আশপাশের জমিতে লবন পানি তুলে দেয়। ফলে এখানে কোন ধরনের চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। স্থানীয় জমি মালিকরা বাধ্য হয়ে সব জমি ছেড়ে দেয় চেয়ারম্যানকে। তিনি এখন সব জমিতে লবন পানি উঠিয়ে ঘের করছেন।
খাল ও জমি জবর দখলের বিষয় নিয়ে লক্ষীখোলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আলহাজ এসএম ওলিউল্লাহ বলেন, ২০২০ সালে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ডিসিআর নেয়া হয়। পরে আমরা উক্ত খাল সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেই। ২০২১ সালে শেখ ওবায়দুল্লাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সমিতির লোকজনদের মারপিট করে জবর দখল করে নেয়। পরে ইউএনও দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর উভয়পক্ষকে নিয়ে বসাবসি হয়। সেসময় ইউএনও আমাদের পক্ষে রায় দেয়। পরে সমিতির লোকজন খালে গেলে বন্দুক দিয়ে গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আবার দখল করে নেয়। এরপর আমরা ভয়ে আর খালে যাইনি। এই খালের পাশাপাশি আরো এক হাজার বিঘা জমি জোর করে দখলে নিয়ে মাছ চাষ করছে। লবন পানি ওঠানোর কারণে পুরো এলাকা বর্তমানে বিরানভুমিতে পরিণত হয়েছে।
শুধু জমি দখল নয় গরিবের আশ্রয়ন প্রকল্পে নির্মিত বাড়ি ঘরের টিন পর্যন্ত নিয়ে গেছে চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ। ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ব্রীজের নিচে নির্মিত আশ্রয়ন প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় তিন বিঘা জমি নিয়ে করা পুকুরটি শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সেই পুকুরের প্রায় ৪/৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করে দিয়েছে চেয়ারম্যান। আশ্রয়নের বেশ কিছু ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরনো ঘর থেকে মানুষদের বের করে দিয়ে খাস জমিতে নিজেই চাষাবাদ করছে। আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসকারিরা চেয়ারম্যানের ভয়ে মুখ খোলেন না।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ভান্ডারকোর্ট ইউপি চেয়ারম্যান শেখ ওবায়দুল্লাহ বলেন, আমি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি। আমি কারো জমি জবর দখল করিনি। এলাকায় বিচার শালিস করতে গেলে রায় কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যায়। যাদের বিপক্ষে যায় তারাই আমার বিরুদ্ধে বদনাম করছে। যাদের জমি রয়েছে তারাই ধান চাষ করছে। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখাশোনা করি। ভুমিহীনরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। আর পুুকুরের মাছ বিক্রি করেছি ঘাট করে দেয়ার জন্য। এ নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। জমি দখলের বিষয় নিয়ে স্থানীয় এমপি ননী গোপাল মন্ডল বলেন, আমি ভুমিহীনদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বটিয়াঘাটা থানার ওসিকে তদন্ত পূর্বক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। আমি বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সাথে আবারও আলাপ করবো।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button