জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় জনপদ কয়রার মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রভাব

রিয়াছাদ আলী, কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি ঃ জলবায়ুর প্রতিনিয়ত বদলে বদলাচ্ছে আবহাওয়া ও পরিবেশ। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মানুষের যাপিত জীবন ও অর্থনৈতিক খাতগুলোয়। এতে উপকূলীয় খুলনার কয়রায় বিভিন্নভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। সংকটে রয়েছে উপকূলবাসীর জীবন। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে আবাদি জমি, বাস্তুহারা হচ্ছে মানুষ, উৎপাদন কমছে কৃষিতে, মারা যাচ্ছে পুকুর-ঘেরের মাছ। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা কৃষিনির্ভর হওয়ায় হুমকিতে পড়েছেন কৃষিজীবী মানুষ। টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সুন্দরবন, উপকূল সুরক্ষা, সুপেয় পানি, জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু ও পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে উপকুলীয় এ জনপদের বিভিন্ন সংগঠন। কয়রার দক্ষিন বেদকাশি ইউনিয়নের খাশিটনা গ্রামের বাসিন্দা মনিরা বেগম। তার স্বামী- নেই। স্বামী বাঘেরে আক্রমনে মারা গেছে। গত কয়েক বছরে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙ্গনে কেড়ে নিয়েছে তার বসতবাড়ি। বর্তমানে কোন জায়গাজমি কিছুই নেই তার। বেড়িবাধের উপর একচিলতে ঘরটি ছাড়া তার কোনো সম্বল নেই, যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই। এভাবেই বছরকে বছর বসবাস করছে। শুধু মনিরা নয় এ রকম নদী ভাঙ্গনের স্বীকর অনেক মানুষ বসাবস করে নদীর বাধের উপর। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা গ্রামের কৃষক আয়ুব আলী বলেন তিন বিঘা জমি রয়েছে। আগে এসব জমি থেকে বছরে ধানে খোরাকি হয়ে যেত। কিন্তু এখন জমির পাশে লোনা পানি মৎস্য ঘেরে আগের চেয়ে লবন বেড়ে যাওয়ায় চাষ করতে পারছেন না ধান। তার পরেও চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঐ এলাকার কওছার শেখ তিনি বলেন, মার্চ-এপ্রিল মাসে লোনা পানির প্রভাব বেশি থাকে৷ এতে অন্য কোনো রবিশষ্যও চাষ করা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের পাথরখালী গ্রামের সাহেব আলী বলেন, শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যাচ্ছে এ জনপদের সব পুকুর ও ডোবা। ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে সুপেয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহৃত পানির তীব্র সংকট। বাড়ির পাশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার একটি প্রকল্পের জলধারের ব্যবস্থা করা হলেও রান্নার পানির অভাব রয়েছে প্রচুর। ৪নং কয়রা গ্রামের আয়শা বেগম বলেন, গরম এলেই তীব্র পানির সংকটে ভুগি আমরা। প্রচন্ড গরমের কারণে পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। আশপাশের সব এলাকায় লবণাক্ত পানি। বাধ্য হয়ে এ পানিতে গোসল রান্না ও খাওয়ার কাজে ব্যবহার করতে হয়। সুতিরধার এলাকার ইউপি সদস্য আবু সাইদ মোল্যা বলেন, ১০/১৫ কিঃমিঃ দুরে জোড়শিং কিংবা বজবজা এলাকা হতে পানি এনে পান করতে হয় তাদের। গাজীপাড়া গ্রামের রিনা মুন্ডা বলেন, লবনাক্তায় কারনে সম্প্রতি মহিলাদের নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রজনন স্বাস্থ্যতে চরম ঝুকিতে রয়েছে তারা। কয়রা উন্নয়ন সংগ্র সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, এই অঞ্চলের মানুষকে দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে বিনা সুদে ও দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে গৃহ ঋণের ব্যবস্থা করা, নিরাপদ ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা, লবণ সহিষ্ণু চাষাবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটানো, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টেশনের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলে লবণাক্ততা হ্রাসে উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণ, শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্বল্প অথবা বিনা সুদে ঋণদান, স্থানীয় পর্যায়ে স্বল্প কার্বন উৎপাদনকারী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সরকারিভাবে কিংবা বে-সরকারিভবে পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, শুকনো মৌসুমে এই এলাকায় খাবার পানির সংকট রয়েছে। উপকূলবাসীর পানি সংকট নিরসনে কয়েক বছরে সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও সংকট মিটছে না। প্রতি বছর গভীর নলকুপ ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং স্থাপন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষনে ট্যাংকি দেওয়া হচ্ছে প্রচুর।কয়রা উপজেলা দুর্যোগ বিষয়ে কাজ করা এনজিও সংস্থা জেজেএসের আঃ মালেক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে উপকূলে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার ওপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি থেকে পরিত্রান পেতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এস মে শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি, জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া সুপেয় পানির সংকট নিরসনে গভীর নলকূপ স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষনে ট্যাংকি প্রদান, পুকুর খনন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং স্থাপন করা হয়েছে। উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে কয়রা-পাইকগাছার সংসদ সদস্য মোঃ রশীদুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকারের পক্ষ হতে কয়রার মানুষের জীবন মান বাঁচনোর লক্ষে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। এটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ জনপদের মানুষের কষ্ট লাঘবে লবন পানীর মৎস্য ঘের বন্ধ করে মিষ্টি পানির মৎস্য ঘের করে তার সাথে ধান চাষাবাদ করার বিষযটি পক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়া টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণের জন্য অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্যও নানা পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।