মানসিক স্বাস্থ্য ও আমাদের ভুল ধারনা

আমাদের সবারই কামনা আমাদের সন্তান যেনো থাকে দুধেভাতে। কিন্তু তা তো হয় না সবসময়। আমরা যতই ভালবাসা আর প্রার্থনায় থাকি না কেন রোগ ব্যাধি এবং দুঃখকষ্ট থেকে আমরা মুক্ত নই। শারীরিক এবং মানসিক রোগে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। মৃত্যু হচ্ছে নানান রোগে এবং ব্যাধিতে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে নানান কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে নানান অপচিকিৎসা এবং চিকিৎসক-রোগী দূরত্ব। মানসিক রোগ কি শুধু মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ? কখনোই নয় বরং তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, জীবনকে সঠিকভাবে উপভোগ করতে না পারা এবং অন্যেও বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার পরিমানটাই বেশি। অনেকবার সম্ভবত বহুবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব তুলে ধরলেও বিশ্বজুড়ে আরও এ ব্যাপারটা অবহেলিত। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং ব্যাধির কারনে তৈরি হয় জীবনে নিরাপত্তাহীনতা এবং অনিশ্চয়তা।
গবেষকরা নিরাপত্তার ব্যাপারটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন এবং তা হলো সম্পর্কের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, শারীরিক অবয়ব এবং গঠনগত নিরাপত্তা, চাকুরী বা কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদার নিরাপত্তা। প্রত্যেকটির আবার বিভিন্ন ভাগ উপভাগ আছে। দার্শনিকের ভাষায় জীবন মানেই অনিশ্চিত হলেও বিজ্ঞানের ভাষা অজানা পথই অনিশ্চিত। জানা পথের ঠিকানা নিশ্চিত করার জন্যেই গবেষণা এবং পর্যালোচনা। মানসিক স্বাস্থ্যগত নানান সমস্যা আমাদের জীবনকে কওে তোলে অনিশ্চিত এবং অনিরাপদ। নিরাপত্তাহীনতা এবং অনিশ্চয়তা থেকে যেমন মানসিক সমস্যা হতে পারে ঠিক উল্টো পথে মানসিক সমস্যা আমাদের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সিরিয়াস মেন্টাল ইলনেস বা গুরুত্বপূর্ন মুখ্য মানসিক রোগ বলে কিছু মানসিক রোগকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার মধ্যে আছে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার, মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসওর্ডারসহ বেশ কয়েকটি মানসিক রোগ। এসব রোগ যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি এবং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয় তাই সামাজিক সম্পর্কে নানান অবনতি দেখা যায়। প্রথম প্রথম অনেকে সাহায্য সহযোগিতা করলেও একটা পর্যায়ে আর দায়িত্ব নিতে চায় না। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ছেদ কিংবা ভাই/বোনকে আলাদা করে দেওয়া এসব রোগে অহরহ দেখা যায়। সন্তানের সুস্থ্যভাবে বেড়ে ওঠা সম্ভব হয় না অনেকক্ষেত্রে যদি তার বাবা বা মায়ের কারো এরকম গুরুতর মানসিক রোগ থাকে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় এবং সামাজিক সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এখনো বাংলাদেশের অনেক জায়গায় পরিবারের কারো মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটায় পরিবারকে এক ঘরে বা আলাদা কওে দেওয়ার ঘটনা শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সমাজে বসবাসরত মানুষ আক্রান্ত ব্যাক্তিকে নানান আক্রমণ এবং বুলিং করে। আধুনিক সমাজ ব্যাবস্থায় প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সম্পদ ছাড়া জীবন অচল। যে ব্যাক্তি সংসারের সকল খরচ বহন করেন তিনি যদি কোনভাবে আক্রান্ত হোন তাহলে সংসারের অন্য সদস্যদের জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। বেকারত্ব তৈরি হয় এবং কাজের পরিমান কমে যায় বিভিন্ন মানসিক রোগে।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ২০২১ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে বয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ কোন না কোন সময় মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের জনসংখ্যার হিসাবে এই সংখ্যা তিন কোটির বেশি। যদিও এই হিসেবে অধিকাংশ মানসিক রোগীই হয়তো সিরিয়াস মেন্টাল ইলনেস (এসএমআই) ভুগছে না কিন্তু যারাই ভুগছে তারাই নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মাদকাসক্তি এবং অভ্যাস আসক্তি বর্তমান সমাজে প্রকট আকার ধারণ করেছে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত না হওয়ায় দিনদিন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপকর্ম এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকাতে ডিপার্টমেন্ট অফ নারকোটিকস এর হিসাব মতে মাদকাসক্ত ব্যাক্তির দ্বারা মোট অপরাধের ৫০ ভাগ সংগঠিত হয়েছে গত দশকে। প্রত্যেকের জীবন সীমানার মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট সময় আছে। মাদকাসক্ত ব্যাক্তির চাকুরীহীনতা, অগোছালো জীবনযাপন এবং সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারনে তার এবং তার পরিবারে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।
আতœহত্যা, ব্যাক্তিত্বের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, শুচিবাই, বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা বা ডিমেনশিয়া রোগের মতো রোগগুলিতে প্রয়োজন হয় নানানরকম যতœ, দেখাশোনার জন্যে কাছের মানুষ, সাইকোথেরাপি, ঔষধ এবং নানান রিসোর্সের। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে আমাদেও দেশের যে আর্থ সামাজিক অবস্থা তাতে এসব রোগের চিকিৎসা এবং পরামর্শের ব্যায়ভার অনেক সময়ই রোগীরা বহন করতে পারে না। অনেকে আবার অজ্ঞতার কারনে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। বিশেষ করে মানসিক রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু ওষুধ খেয়ে খানিকটা স্বাভাবিক হলে উঠলে পরবর্তীতে আর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না বা ওষুধ খান না। কিন্তু মানসিক রোগের চিকিৎসাটা এমন যে, ওষুধের পাশাপাশি কিছু আচরণগত, মানসিক কিছু ব্যবস্থাপনা নিয়মিত অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু এগুলো অনুসরণ করার ক্ষেত্রে রোগীদের আগ্রহ কম থাকে। ফলে যে অনিরাপদ অস্থির অনিশ্চিত জীবনের দিকে রোগী এবং পরিবার যাচ্ছিলো সেদিকে আরও এক ধাপ তারা এগিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদিন পর লক্ষণগুলো চলে গেলে রোগী ওষুধ বন্ধ কওে দেন, ফলোআপ করেন না। ফলে কিছুদিন ভালো থাকার পর আবার তার মধ্যে রোগ জোরালো হয়ে ওঠে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই বলেন শরীরের অন্য যেকোনো রোগের মতো মানসিক রোগকেও একটি অসুখ হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও গ্রামীণ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও এই বিষয়ে সচেতন করে তোলা জরুরি বলে মনে করি। এছাড়া খাদ্যাভ্যাস জনিত মানসিক রোগ, ঘুমের সমস্যা, নানারকম যৌন মানসিক রোগ, শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা ও রূপান্তর রোগ সামাজিক নানান সমস্যার মূল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছে। অন্যভাবে চিন্তা করলে খাদ্য এবং যৌন বিষয়ক রোগগুলি আমাদেও মৌলিক চাহিদার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
এই সব সমস্যায় বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং প্রচলিত ভুল প্রথার গোলকধাঁধায় পরে মানুষ এমন কিছু করছে যা তার মৌলিক। নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে মানসিক রোগীর সুস্থ্য হওয়া বলতে বুঝায় স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করা, সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে পারা , সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারা এবং অন্যের জন্যে বোঝা না হওয়া। অধিকাংশ মানসিক রোগীই এর কোন একটিতে বা সবগুলোতেই চিকিৎসা ছাড়া ব্যার্থ হয় যা তৈরি করে অনিরাপদ অনিশ্চিত ব্যাক্তি জীবন, সামাজিক জীবন এবং জীবিকা জীবন। এসব ব্যাপারে আরও অধিকতর সচেতনতা, গবেষণা এবং সরকারি বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজন অন্যথায় বাড়বে মানসিক বিকলাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বোঝা।
ডা: মোহাম্মদ হাসান
সাইকিয়াট্রিস্ট
ব্রেইন এন্ড মাইন্ড স্পেশালিস্ট