সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪২.২ : স্কুল শিক্ষকের মর্মান্তিক মৃত্যু

তাপপ্রবাহ : আরো তিন দিনের সতর্কবার্তা জারি
স্টাফ রিপোর্টার ঃ গতকাল রোববারও খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো যশোরে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি। যশোরে প্রচ- গরমে অসুস্থ হয়ে আহসান হাবিব নামের এক স্কুলশিক্ষকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। রোববার (২৮ এপ্রিল) সকাল ৯টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। আহসান হাবিব যশোর সদর উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. হাবিবুর রহমান শিক্ষক আহসান হাবিবের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরিবারের লোকজন বলেছেন, তিনি হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। তবে, হাসপাতালের চিকিৎসকরা এটিকে নরমাল স্ট্রোক বলে দাবি করেছেন। মৃত আহসান হাবিব যশোর সদর উপজেলার সিলুমপুর গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে। আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এজেডএম পারভেজ মাসুদ জানান, শিক্ষক আহসান হাবিব আজ সকালে মাঠে কাজ করে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, গতকাল (২৮ এপ্রিল) সকালে ওই স্কুলশিক্ষককে (আহসান হাবিব) মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন যে আজ সকালে রোদের মধ্যে তিনি মাঠে কাজ করে স্কুলে গিয়েছেন। স্বজনদের দাবি, তার হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। তবে আমরা এখনো চূড়ান্ত রিপোর্ট পাইনি। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের ধারণা, তিনি হার্ট অ্যাটাকেও মারা যেতে পারেন। এদিকে গতকাল খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই দিনে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপামাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে দেশজুড়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে নতুন করে আরও তিন দিনের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল রোববার সকালের বুলেটিনে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, গতকাল রোববার দুপুর তিনটার পর খুলনা বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে। এই জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই সময়ে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া মোংলা ৪০.৮ ডিগ্রি, কুমারখালী (কুষ্টিয়া) ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি, কয়রায় ৩৯.৬ ডিগি, ইশ^রদীতে ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি এবং সাতক্ষীরায় ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রের্কড করা হয়। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়াবীদরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরে মাঝারি, তীব্র ও অতি তীব্র দাবদাহ চলছে চুয়াডাঙ্গায়। এর মধ্যে ৭ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। গতকাল রোববার বেলা ১২টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শনিবার ৩টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে তীব্র দাবদাহের কারণে প্রশাসনের তরফ থেকে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগীর চাপ অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। প্রচ- তাপদাহে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সেই সাথে বাতাসের আদ্রতা বেশি থাকায় অনুভূত হচ্ছে ভ্যাপসা গরম। তাপদাহে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সর্বত্র লু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। দুপুরের পর ঘরে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তাপদাহে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। এদিকে আবহাওয়া অফিস নতুন করে ৭২ ঘণ্টা হিট এলার্ট জারি করেছে। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া সিনিয়র পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, আগামী ৫-৬ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমার লক্ষণ নেই। আরো বাড়তে পারে। অপরদিকে দেশজুড়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে নতুন করে আরও তিন দিনের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গতকাল রোববার সকালের বুলেটিনে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে গরমে অস্বস্তিকর অনুভূতিও বাড়বে। এপ্রিল এমনিতেই দেশের উষ্ণতম মাস। চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতে গরমের তীব্রতায় হাঁসফাঁস করতে হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই মাস আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরা হয়। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির উপরে উঠলে তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। গত শনিবার দেশের ৪২ জেলার উপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলায় বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জেলায় টানা দ্বিতীয় দিনের মত পারদ উঠেছিল ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এই মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এছাড়া রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়ার উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বইছে দিনাজপুর, রাঙামাটি, চাঁদপুর, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বাকি অংশে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে। বৃষ্টি না হওয়ায় এবার চৈত্র মাসের শেষ সময় থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। চলতি মৌসুমে ৩১ মার্চ থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত টানা ২৯ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলছে, যা নজিরবিহীন। তীব্র গরমের কারণে বাইরে বের হলে ‘অগ্নিবায়ু’ সয়ে চলতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। হাসপাতালে রোগী বাড়ার পাশাপাশি নিয়মিত মৃত্যুর খবরও আসছে। পশু-পাখি ও ফসলের ওপরও গরমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শেষ তিন দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত ও শীতের দিন কমছে, বছরের বড় অংশজুড়ে গরমের বিস্তার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে পরিবেশ আরও অসহনীয় হয়ে ওঠছে। এর মধ্যে গত বছর ‘অস্বাভাবিক’ গরমের মধ্যে কাটিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি মৌসুমের আগের ৭৫ বছরের মধ্যে টানা সর্বোচ্চ ২৩ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে চলে ২০২৩ সালে। ওই বছরের এপ্রিলের শেষ ১৮ দিন ও মে মাসের শুরুর ৫ দিন দাবদাহ ছিল দেশে। চলতি বছর আরও গরমের সতর্কতাবার্তা দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন, “জলীয়বাষ্প পুঞ্জীভূত হয়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা। সেটি পুঞ্জীভূত না হয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এ কারণেই গরম বেশি থাকছে।” কালবৈশাখী এবং বৃষ্টি না থাকার কারণে এবার গরমের তীব্রতা বেশি বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ। তার ভাষ্য, “গত বছর বাতাসে আর্দ্রতা কম ছিল। এবার আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে মানুষের শরীর ঘামছে, অস্বস্তি বেশি হচ্ছে। এই সময়ে পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। এবার বৃষ্টিপাত কম।”