খুলনার ‘ভূইয়া ম্যানশন’ এখন নিরব ভয়ে শিমুলের বিষয়ে মুখ খুলছেন না কেউ!

কসাই জিহাদও খুলনার ভয়ঙ্কর খুনি
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ঃ আলোচিত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে শিমুল ভুঁইয়া ও তার ভাতিজা তানভীর ভুঁইয়া গ্রেফতারের পর ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের বাড়ি ‘ভূইয়া ম্যানশন’ থেকে পরিবারের সকলেই আত্মগোপন করেছেন। গত তিন দিন ধরে তাদের দামোদরের বাড়ি তালাবদ্ধ। বিরাজ করছে নিরবতা। তবে মাহমুদ হাসান ভূঁইয়া ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ও তার পরিবার সম্পর্কে ভয়ে মুখ খুলছেন না এলাকাবাসী। তাদের ধারণা, ভুঁইয়া পরিবারের হাত অনেক লম্বা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে কিছু দিন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা- নিয়ে তোলপাড় হলেও শিমুল ভুঁইয়ার কিছুই হবে না। এ কারণে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়ে কেউ বিপদ ডেকে আনতে চান না। এলাকাবাসী সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) সামরিক শাখার প্রধান মাহমুদ হাসান ভূঁইয়া ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ ওরফে আমানুল্লাহ সাঈদ ওরফে শিহাব ওরফে আবুল ফজল ওরফে ফজল মোল্লা ওরফে ফজল গ্রেফতারের আগে আত্মগোপনে থাকলেও মাঝে-মধ্যে রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে দামোদরে গ্রামের বাড়িতে আসতেন। তবে বয়স্ক দু-একজন ব্যক্তি ছাড়া এলাকার কোনো মানুষ তাকে চিনত না। ফুলতলা বাজারসহ আশপাশ এলাকার দোকানগুলোতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শিমুল ভুঁইয়ার ছবি দেখার জন্য কৌতুহলী মানুষেরা ভিড় করে। পত্রিকায় শিমুল ভুঁইয়ার ছবি দেখে একজন মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘এমন সুন্দর চেহারার মানুষ- ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ও নিষ্ঠুর হতে পারেন-ভাবতে পারছি না’। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ শিমুল ভুঁইয়ার নাম শুনলেও তাকে সরাসরি কেউ দেখেননি। তার ছবিও দেখা যায় না। তার সন্ত্রাসী জীবনের কাহিনী সবাই জানে। ফলে তার প্রতি স্থানীয় মানুষের কৌতুহল রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিমুল ভুঁইয়া ফুলতলা উপজেলার দামোদর মুক্তময়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। ক্লাস এইট পর্যন্ত তার রোল নম্বর এক ছিল। এরপরই সে অপরাধ জগতে জড়িয়ে যায়। এ ব্যাপারে তার এক স্কুল বন্ধুর কাছে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। তবে, দামোদর গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, শিমুল ভুঁইয়া রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স পাশ করার কথা বলা হলেও এটি ঠিক নয়। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, খুব কম বয়সে সে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। একাধিক হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে তার যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে সে এতদিন পলাতক জীবনযাপন করেছে। ফলে তার লেখাপড়াও খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এদিকে, শিমুল ভুঁইয়ার মতো তার ভাই-ভাতিজাও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী ও পুলিশ। তাদের মতে গোটা পরিবারই সন্ত্রাসী। তারা জানান, শিমুলের সেজো ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ ভুঁইয়া ওরফে মুকুল ভুঁইয়া। বোমা তৈরি করতে গিয়ে তার ডান হাত উড়ে যায়। এরপর তার নাম হয় ‘হাত কাটা মুকুল’। সে-ও চরমপন্থি দল জনযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। একাধিক মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০০৪ সালের সে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। শিমুলের ছোট ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভুঁইয়া ওরফে শিপলু ভুঁইয়া। সে দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যা মামলাসহ তার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা ছিল। তবে বর্তমানে একটি মামলাও তার বিরুদ্ধে নেই। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার তানভীর ভুঁইয়া শিমুলের বড় ভাই হানিফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে লাকি ভুঁইয়ার ছেলে। তানভীর ভুঁইয়া তিন বছর আগে অস্ত্র ও মাদকসহ দামোদরের ভৈরব নদীর পাশ থেকে গ্রেফতার হয়। ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শিপলু ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা ছিল তা আদালত থেকে খারিজ হয়ে গেছে। এছাড়া গত ১০ বছরে তার নামে একটি মামলাও হয়নি। তবে তার ভাতিজা তানভীর ভুঁইয়া তিন বছর আগে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছিল তা নিশ্চিত করেন তিনি। শিমুল ভুঁইয়াদের দামোদরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। ঘরের দরজা-জানালাও বন্ধ। স্থানীয়রা জানান, ঢাকায় শিমুল ভুঁইয়ার গ্রেফতারের পর থেকেই তার ভাই ইউপি চেয়ারম্যান শিপলু ভুঁইয়াসহ বাড়ির সকলে গা ঢাকা দিয়েছেন। ৫বছর আগে শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে সম্পর্ক হয় আজিজেরঃ সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকা-ে গ্রেফতার ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামের আজিজ ওরফে আজির (৩৫) সঙ্গে পাঁচ বছর আগে চরমপন্থি দলের নেতা শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ফুলতলা বাজারের দরিদ্র ডাব বিক্রেতা আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে সে। ১০ বছর আগে আজি ফুলতলা বাজারসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ভ্যান চালাতো। একবার আলকা গ্রামে চুরি করে ধরা পড়ে। তারপর সে ট্রাকের হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করে। পরে সে ট্রাক ড্রাইভার হয়। তিন বছর আগে আজি ফুলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এর পাশাপাশি সে চরমপন্থি দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। শিমুল ভুঁইয়ার সঙ্গে তার গ্রেফতার হওয়ার খবর প্রচার হওয়ার পর ফুলতলা এলাকার মানুষ হতবাক হয়ে পড়ে। ভারতে গ্রেফতার কসাই জিয়াদের বাড়ি দিঘলিয়ায় : সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের লাশ টুকরো টুকরো করার অভিযোগে ভারতের মুম্বাইয়ে গ্রেফতার জিহাদ হাওলাদার (২৪) ওরফে কসাই জিহাদের বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে। ফুলতলা ও দিঘলিয়া পাশাপাশি উপজেলা। মাঝখানে ভৈরব নদী। শিমুল ভুঁইয়ার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে বারাকপুর গ্রামের গাজীপাড়ার রং মিস্ত্রি জয়নাল হাওলাদারের ছেলে সে। ভারতের মিডিয়ায় জিহাদ হাওলাদারকে কসাই হিসাবে বর্ণনা করা হলেও স্থানীয়ভাবে তাকে কেউ ‘কসাই’ হিসাবে কাজ করতে দেখেনি। তবে প্রায়ই ভারতে যাতায়াত করে। ভারতের মুম্বাইয়ে বারাকপুরসহ দিঘলিয়া উপজেলার অনেক মানুষ কাজ করে। হয়ত জিহাদ তাদের কাছে গিয়ে কোনো কাজকর্ম করতে পারে। তবে, একজন সংসদ সদস্য খুনের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে জিহাদ তা এলাকার কেউ ভাবতে পারছে না। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ। বারাকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গাজী সাহাগীর হোসেন পাভেল বলেন, জিহাদ হাওলাদারকে গত দেড়-দুই বছর এলাকায় দেখা যায় না। আমাদের এলাকায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ করারও কোনো অভিযোগ নেই। তার পরিবার ভালো । তার আব্বা রঙ মিস্ত্রির কাজ করত। বড় ভাই-ভাবি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আরেক ভাইও মাদ্রাসার শিক্ষক। দিঘলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আকতার বলেন, ভারতে জিহাদ হাওলাদারের গ্রেফতারের ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছ থেকে অনেক ফোন পাচ্ছি। তবে আমাদের কাছে তার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা দেননি। তারপরও আমরা জিহাদ হাওলাদারের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।