সেই সোহেল আরমান-ই ভূয়া ম্যাজিস্ট্রেট!
সৈয়দপুর ট্রাষ্টের অর্থ আত্মসাতে চাকরিচ্যুত
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ঃ খুলনা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) স্বাক্ষর জাল, চেকের পাতায় নির্ধারিত টাকার অংকের বাম পাশে নতুন করে অতিরিক্ত সংখ্যা যোগ এবং ভূয়া চিঠি প্রেরণ করে জেলা প্রশাসকের আওতাধীন রাজস্ব বিভাগে কর্মরত কয়েকজন স্টাফ দু’টি ব্যাংক থেকে ১১টি চেকে উঠিয়ে নেন সৈয়দপুর ট্রাষ্টের ১৫ লাখ টাকা। আবার একই পদ্ধতি ব্যবহার করে ট্রাষ্টের স্থায়ী জামানত (এফডিআর)’র আরও ২৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। এভাবেই মোট ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। আর এ অপরাধের মূল হোতা ছিলেন ভিপি শাখার অফিস সহায়ক এম . সোহেল আরমান ও রাজস্ব শাখার ট্রেসার ও সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট খুলনার নাজির মোঃ আব্দুর শাকুর শেখ। এ অভিযোগে তাদের চাকরিচ্যুতও করা হয়। মামলাও দায়ের করে দুদক। কিন্তু সবকিছুকে আড়াল করে পিয়ন থেকে বনে যান ভূয়া ম্যাজিস্ট্রেটে। সবার চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ সেজে নগরীতে একের পর এক ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের নামে হাতিয়ে নিচ্ছিলেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু বিধি বাম, এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। অবশেষে গোয়েন্দা জালে আটকে গেছেন বড় মাপের এই প্রতারক। সোমবার (১০ জুন) গভীর রাতে নগরীর বৈকালী এলাকা থেকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাকে আটক করে। প্রতারক সোহেল আরমান বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের ডুবি গ্রামের মো. আবুল ফজলের ছেলে। মঙ্গলবার দুপুরে কেএমপির ডিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কেএমপির ডেপুটি কমিশনার (ডিবি) মো. নুরুজ্জামান জানান, গত ৮ জুন সোহেল আরমান নগরীর ডাকবাংলো এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নামে ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন। পরে জেলা প্রশাসন জানায়, ঐ দিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেনি। ঔ সূত্র ধরে মাঠে নামে কেএমপির গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। পরে প্রতারক সোহেল আরমানকে আটক করা হয়। ডিবি প্রধান নুরুজ্জামান আরো জানান, আটক করার পর সোহেল আরমানের কাছ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সিল, জরিমানা বা কারাদন্ড দেওয়ার রশিদ বই, অভিযোগ গঠন ফর্মসহ ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। গত দুই মাসে সোহেল আরমান ২৪টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আদায় করেছে। এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে আর কারা করা সম্পৃক্ত আছে- সেটিও খোঁজা হচ্ছে।
ফ্লাশব্যাক : এর আগে অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় রাজস্ব শাখার ট্রেসার ও সৈয়দপুর ট্রাস্ট এস্টেট খুলনার নাজির মোঃ আব্দুর শাকুর শেখ ও ভিপি শাখার অফিস সহায়ক এম . সোহেল আরমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও শোকজের পরই আত্মগোপন করেন সোহেল।
গত ৪ সেপ্টেম্বর বিষয়টি ধরা পড়লে গত বছরের ৫, ৯ ও ১১ সেপ্টেম্বর খুলনা সদর থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। একইসঙ্গে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের সূত্রে থেকে জানা গেছে, দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীনের সব সম্পদ দিয়ে সৈয়দপুর ট্রাস্ট গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে স্টেটের প্রধান। রাজস্ব বিভাগ ট্রাস্টের সম্পদ দেখাশোনা করে। এর অর্থ দিয়ে গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, দুস্থদের সহযোগিতাসহ সেবামূলক কাজ করা হয়। সূত্র জানায়, নগরীর এনআরবিসি ও ইসলামী ব্যাংকে ট্রাস্টের দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ট্রাস্টের ব্যাংক হিসাব পরীক্ষণের সময় অসংগতি ধরা পড়ে। যাচাইয়ের পর স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা উত্তোলনের বিষয়টি ধরা পড়ে। ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল থেকে গত ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১টি চেকে এ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগের (ট্রেসার) দায়িত্বে ছিলেন নাজির আব্দুশ শাকুর। এ বিভাগের চেক বইসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব তার। কিন্তু তিনি দায়িত্ব অবহেলা করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি অফিস সহায়ক সোহেল আরমানকে দিয়েই সব কাজ করাতেন। আর এ সুযোগে সোহেল চেক নিয়ে জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। এমনকি ব্যাংক হিসেবেও তার নিজের মোবাইল নম্বরও দেয় সে। ফলে টাকা জমা বা উত্তোলন সংক্রান্ত যে কোন ম্যাসেজ তার মোবাইলেই আসতো। এছাড়া এ শাখার সাবেক উচ্চমান সহকারী (দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী) মো. কবির হোসেনও ওই শাখায় দায়িত্ব পালনকালীন তার বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে তাকেও শোকজ করা হয়েছে। কবিরকে সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখায় উচ্চমান সহকারী হিসেবে বদলি করা হয়। সে বর্তমানে সেখানেই কর্মরত রয়েছে। এই সূত্র জানান, নাজির শাকুর, কবির ও সোহেল যোগসাজস করে সৈয়দপুর ট্রাস্ট এবং খান-এ-সবুর ট্রাস্ট্রের সম্পত্তি তদন্ত এবং বরাদ্দের নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন। এ ঘটনা ফাঁস হলে সোহেল আত্মগোপন করে। এমনকি সে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে অফিস না করেই বেতন-ভাতা উত্তোলন করে বলেও অভিযোগ উঠেছে।