কোন পথে খুলনা নগর বিএনপি?
তিন মাসের কমিটিতে আড়াই বছর পার!
পকেট কমিটি গঠণের পরিকল্পনা
পদ বাণিজ্যের অভিযোগ ভাইরাল
নানা বিতর্কে আলোচনায় এক শীর্ষ নেতা
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : তিন মাসের জন্য গঠিত খুলনা মহানগর বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির মেয়াদ আড়াই বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু গঠন করা সম্ভব হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। যদিও পূর্ণাঙ্গ কমিটির পরিবর্তে তিন মাস পর আহবায়ক কমিটিকেই পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়। এছাড়া থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলোও চলছে আহবায়ক কমিটি দিয়ে। এখন সম্মেলনের মাধ্যমে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের নামে চলছে কতিপয় নেতার পছন্দের লোকদের দিয়ে ‘পকেট কমিটি’ গঠনের তোড়জোড়। তবে, পকেট কমিটি গঠনের পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
এদিকে, বর্তমান নেতৃত্ব নগর শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে দলকে সাংগঠনিক শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষমতার পরিচয় দিতে না পারলেও আন্দোলনের কঠিন সময় আত্মগোপন, ওয়ার্ডে পকেট কমিটি গঠনের পরিকল্পনাসহ জড়িয়েছেন নানা বিতর্কে। এর মধ্যে নগর শাখার এক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে বারবার নারী কেলেঙ্কারীতে সম্পৃক্ততা এবং গ্রেফতার এড়াতে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের এক নেতার বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ এবং সর্বশেষ মহিলাদলের এক নেত্রীকে পদ-পদবীর প্রলোভনে ফেলে অর্থ দাবির বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এমনকি পদ বাণিজ্যে মুখ খুললে এবং পকেট কমিটি বাস্তবায়নের বাইরে কেউ প্রার্থী হলে তাদের দল করতে দেওয়া হবেনা বলেও হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অপরদিকে, মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশকে বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়ায় দলে বিভেদ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে এবারও নগর শাখার সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু অনুসারীদের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। বিএনপির কমিটি থেকে মঞ্জু অনুসারীদের বাদ দিতে গিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক ত্যাগী নেতাকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার নিষ্কৃয়, অথচ: বর্তমান নেতৃত্বের আস্থাভাজন একাধিক নেতাকে বিভিন্ন পদে বসানো হয়েছে।
এতে করে বর্তমান নেতৃত্বের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, বিভাগীয় শহরে যে মানের নেতৃত্ব দরকার তা না থাকায় খুলনায় বিএনপি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি কর্মীদের আস্থার সংকটও রয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটি শফিকুল আলম মনাকে আহবায়ক ও শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করে মহানগর বিএনপির ৩ সদস্যের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এতে কমিটি থেকে বাদ পড়েন এক যুগ ধরে সভাপতি পদে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা সাবেক মেয়র মো. মনিরুজ্জামান মনি। হঠাৎ করে কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করায় মাত্র চার দিন পর ১৩ ডিসেম্বর মঞ্জুকে শোকজ এবং ২৫ ডিসেম্বর তাকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের পদ থেকে পদত্যাগ করেন মঞ্জুর অনুসারি সহস্রাধিক নেতাকর্মী। সেই থেকে বিএনপির পদ পদবী থেকে দূরে রয়েছেন এই অংশের নেতারা। তবে ‘নগর বিএনপির সাবেক নেতৃবৃন্দ’র ব্যনারে তারা দলীয় বিভিন্ন কর্মসুচি পালন অব্যাহত রেখেছেন। যদিও নগর বিএনপি’র নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়ের নেপথ্যে মঞ্জু-মনি গ্রুপ দায়ী করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলকে।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ ২৯ বছর দায়িত্বে থাকায় খুলনা মহানগর বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির বেশিরভাগ নেতাই নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অনুসারী ছিলেন। আন্দোলন-কর্মসূচি পালন হয়েছে তাদের নেতৃত্বেই। যার কারণে অসংখ্য মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন তারা। কিন্তু সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় দল ত্যাগ না করে অনেকটা ‘অভিমানে’ অপেক্ষায় রয়েছেন পদত্যাগী নেতা-কর্মীরা।
এদিকে, ২০২২ সালের ১ মার্চ মহানগর বিএনপির ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরপর থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আহবায়ক কমিটি করা হয়। পরবর্তীতে সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি। সমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে হামলা-পাল্টা হামলা ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা। সেখানে একজন পুলিশও নিহত হয়। ওই সমাবেশ থেকেই দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ি ৩১ অক্টোবর এবং ১ ও ২ নভেম্বর দেশব্যাপী প্রথম দফায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় ৫ ও ৬ নভেম্বর দু’ দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কিন্তু খুলনায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচি আহবান করেই দায়িত্ব শেষ করেন বিএনপি নেতারা। ২/১টি ঝটিকা মিছিল ও চোরা-গুপ্তা পিকেটিং ছাড়া মাঠে থাকছেন না তারা। উপরন্তু ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পরবর্তী নতুন নতুন মামলায় গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান অনেক নেতা-কর্মী। বিশেষ করে তৎকালীন নগর বিএনপি’র আহবায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা ও সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান। যে কারণে তীব্র আন্দোলনেও নেতা-কর্মীরা তাদের রাজপথে না পেয়ে চরম হতাশ হন। এ দু’ নেতা ওই সময় পাশ্ববর্তী দেশ ভ্রমণে ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নেতাদের অনুপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই সময় সামাজিক মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে পোষ্টদেন অপর নেতা সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা। সবমিলে নেতৃত্বের অভাবেই আন্দোলন অনেকটাই গতি হারিয়ে ফেলে। যদিও পরবর্তী শান্ত পরিস্থিতে তারা পর্দা সরিয়ে জনসম্মুখে বের হন।
এদিকে মহানগর বিএনপির সূত্র জানান, দলীয় কার্যালয়ে গত ২১ জুন মহানগর বিএনপির বর্ধিত সভায় ২৫ জুনের মধ্যে নগরীর সোনাডাঙ্গা, খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করেই ওয়ার্ড সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে ২৩ মে শুধুমাত্র সদর থানার পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৫১ সদস্যের এই কমিটিতে কেএম হুমায়ূন কবীরকে আহবায়ক এবং মোল্লা ফরিদ আহমেদকে সদস্য সচিব করা হয়।
সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটের মাধ্যমে এই থানাগুলোতে আহবায়ক ও সদস্য সচিব নির্বাচিত করা হয়েছিল। থানাগুলোতে পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠনের পর এই থানাগুলোর অধীন ওয়ার্ড কমিটিগুলোতে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৫ জুলাইয়ের মধ্যে খুলনা সদর থানার অধীন ৯ টি ওয়ার্ডে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের কথা রয়েছে। এই সম্মেলনে বিএনপি নেত্রী বেগম রেহানা ঈসাকে প্রধান এবং নুরুল হাসান রুবা এবং মাসুম রশিদকে সদস্য করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। যার প্রথম কর্মসূচি হিসেবে আজ শনিবার (২৯ জুন) ২১, ২৩ ও ২৭ নং ওয়ার্ডের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
দলের তৃণমূলের একাধিক সূত্র ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেছেন, বলা হচ্ছে সম্মেলন। কিন্তু মূলত: সিলেকশনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আনা হবে নগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন এবং সদর থানা আহবায়ক কেএম হুমায়ূন কবীর ও সদস্য সচিব মোল্লা ফরিদ আহমেদের পছন্দের লোকদের। এ জন্য সম্মেলন হলেও যেন তাদের নির্ধারিতদের বাইরে কেউ প্রার্থী না হয়- সেটি আগে-ভাগেই জানান দিয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক প্রার্থীই বহিস্কারের ভয়ে রয়েছেন।
এই সূত্র জানান, নেতৃত্বের পছন্দের তালিকায় যথাক্রমে ২১ নং ওয়ার্ডে আবু সাইদ শেখ ও মোল্লা নূরুল ইসলাম, ২৩ নং ওয়ার্ডে শেখ ইফতেখার হোসেন বাবু ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং ২৭ নং ওয়ার্ডে মাহবুব উল্লাহ শামীম ও মেশকাত আলী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চায় সম্মেলন হলে এ চিত্র পরিবর্তন হতে পারে।
আবু সাইদ শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ২১ নং ওয়ার্ডের সভাপতি প্রার্থী হিসেবে তিনি ও নাজির উদ্দিন আহমেদ নান্নু এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোল্লা নূরুল ইসলাম শুক্রবার দলের মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
শেখ ইফতেখার হোসেন বাবু বলেন, তিনিও ২১ নং ওয়ার্ডে সভাপতি এবং মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এর বাইরে উল্লিখিত দু’টি পদে আর কোন প্রার্থী নেই বলে জানান তিনি।
একইভাবে মাহবুব উল্লাহ শামীম ২৭ নং ওয়ার্ডে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র কেনার কথা নিশ্চিত করে বলেন, এ পদে তার জানামতে আর কোন প্রার্থী নেই। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে মেশকাত আলী ও সাইদুল ইসলাম (গোলকি সাইদ) মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
এ বিষয়ে নগর বিএনপির আহবায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা বলেন, ওয়ার্ড কমিটির নির্বাচন পরিচালনা করছে নির্বাচন কমিটি। এখানে তাদের কোন সে নেই। তবে কাউন্সিলের মাধ্যমে করতে বলা হয়েছে। পকেট কমিটির বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, যাদের মুখ আছে তারা এসব কথা বলতে পারে। তবে এটি ঠিক না।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান বেগম রেহানা ঈসা বলেন, কাউকে মনোনয়নপত্র কিনতে বাঁধা প্রদান বা নিষেধ করা হয়েছে- এমন অভিযোগ তিনি পাননি। আগ্রহী প্রার্থীরা তাদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র কিনে জমা দিয়েছেন। যাচাই-বাছাইও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কোন পদে একক এবং কোন পদে একাধিক প্রার্থী রয়েছে। আজ শনিবার সম্মেলনে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ৩ মাসের জন্য করা মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সংসদ নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় খুলনার বিএনপি নেতারা মাঠে ছিল না, তারা পালিয়ে গিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়া ব্যর্থ নেতাদের দিয়ে কোনো সফল আন্দোলন সম্ভব নয়। এজন্য পরীক্ষিত ও সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন।