হুমকির মুখে খুলনার পোল্ট্রি খামারিরা
চাহিদার অর্ধেক ডিম উৎপাদন
মোঃ মুশফিকুর রহমান (মেহেদী) : ৫ মাস পূর্বেও প্রতি পিস পোল্ট্রি ডিমের খুচরা মূল্য ছিল ৮ থেকে ৯ টাকা। মাত্র ক’ মাসের ব্যবধানে সেই ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকা থেকে ১৪ টাকা। পাইকারি ১১ টাকা ৫০ পয়সা ও খুচরা ১২ টাকা মূল্যে বিক্রি করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ খুচরা দোকানগুলোতে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়। ক্রেতারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কালো হাত পড়ায় দফায় দফায় বাড়ছে ডিমের দাম।
দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন হলেও বর্তমানে লাগামহীন ডিমের দাম। ডিমের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। ডিমের এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে পাইকারি বিক্রেতাদের দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, যোগান কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহৎ ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি খুলনাসহ অন্যান্য জেলার প্রান্তিক খামারিরা।
ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কিছু ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রচন্ড গরমের কারণে ডিম নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। তাছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া রিমাল ঝড়ের কারণে দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা সহ উপকূলের বেশ কয়েকটি অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়েছে। এসব অঞ্চলের অধিকাংশ খামারী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিমের দাম বেড়েছে। যাদের খামারে মুরগি রয়েছে তারা বর্তমানে লাভবান হচ্ছেন বলে জানান তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনায় প্রতিদিন ডিমের চাহিদা রয়েছে চার লাখ। প্রায় ২ লাখ ডিম স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও বাকিটা আসে ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে। উৎপাদনের প্রায় দ্বিগুণ চাহিদা থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল গুলোতে ডিম পাঠায় কিছু নামিদামি প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, এসকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রধানত ১১টি প্রতিষ্ঠান ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, ডায়মন্ড সিক্স লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড, সাগুনা পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি, প্যারাগন গ্রুপ, কাজী ফার্মস লিমিটেড, নারিশ পোল্ট্রি, আকিজ গ্রুপ, আফিল এগ্রো, আমান ফিড, আল মদিনা ও আস্থা পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি। এলিভেন মাফিয়াখ্যাত এই ১১টি প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে ডিমের বাজারমূল্য।
সূত্র জানায়, সারাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ তথা দুই কোটি ডিমের যোগান দেয় এই ১১টি প্রতিষ্ঠান। ফলে ডিমের দাম ওঠা নামার হার নির্ভর করে শীর্ষস্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ছোটখাটো ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও স্বল্প পুঁজির খামারীগণ।
১১ মাফিয়া খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর হতে হয় সাধারণ পাইকারী ব্যবসায়ীদের। সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো দফায় দফায় বাড়িয়ে দিচ্ছে ডিমের দাম। ভোক্তা পর্যায়ে বিপুল চাহিদা থাকায় সমাধান দিতে পারছেন না সরকারি দপ্তরগুলো। তবে সরকার খাবারের দাম কমানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিলে খামারিরা স্থানীয় পর্যায়ে শতভাগ ডিম সরবরাহ করতে পারবে বলে মনে করেন খুলনা পোল্ট্রি ফিশ ফিড মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম সোহরাব হোসেন।
তিনি বলেন, এই ১১টি প্রতিষ্ঠান শীর্ষ স্থানে থাকায় তাদের নিকট খামারির চেয়ে ১ টাকা কম মূল্যে পাওয়া যায়। ফলে পুরো মার্কেট দখল করে আছে তারা। এছাড়া ঋণসহ সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা এ সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানরাই পায়। ফলে একচেটিয়া ভাবে বাজার দখল করে আছে তারা। স্থানীয়ভাবে ডিম শতভাগ সরবরাহ করতে পারলে কিছুটা ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে অস্থিরতা কাটবে ডিমের বাজারে। এছাড়া তিনি আরো বলেন, কাঁচা বাজার, মাছ বাজার, মুরগি ও গরুর মাংসের বাজারের মতো একটি ডিমের বাজার থাকলে এই সংকট কাটবে। এক স্থানে সকল ব্যবসায়ী ও খামারীরা বেচাকেনা করলে নিয়ন্ত্রণে আসবে ডিমের দাম।
নগরীর ময়লাপোতা মোড়ের একজন পাইকারি ডিম বিক্রেতা বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। ডিমের দাম বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো এক হাত থেকে আরেক হাত বদল।
খুলনা নিউ মার্কেটের তারেক এন্টারপ্রাইজের মোনাদ বলেন, বর্তমানে মাছ ও মাংসের দাম অনেক বেশি। ফলে ডিমের প্রতি ক্রেতাদের ঝোক বেশি। হঠাৎ ডিমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পোল্ট্রির খাবারের দাম আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পোল্ট্রি ব্যবসায় হিমশিম খাচ্ছে খুলনার স্থানীয় খামারীরা।
খামারিরা জানান, একদিনের বাচ্চা থেকে প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত একটা মুরগিতে ৮৫০ টাকা খরচ হয়। মুরগির উপযোগী একটি ঘর তৈরি করতে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া একটি মুরগি ডিম পাড়ার উপযোগী হতে সময় লাগে সাড়ে চার মাস। এছাড়া খাবারের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
খামারিরা বলছেন, ডিম উৎপাদনে ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাবারে। আর সেই খাবারের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ডিমের মূল্য বেড়েছে। খাবারের দাম কমলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ডিমের দাম। স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী শতভাগ সরবরাহ নিশ্চিত করলে সিন্ডিকেটের পতন হবে বলে জানান খুলনার কয়েকজন খামারি।
অলোক কুমার নামক একজন পোল্ট্রি খামারি বলেন, আমরা খুলনার যত খামারি আছি, সবাই যদি ১০০ ভাগ ডিম সরবরাহ করতে পারি তাহলে বাইরের সিন্ডিকেট বন্ধ হয়ে যাবে।
খুলনার ডুমুরিয়ায় রিমা খাতুন নামক এক স্বল্প পুঁজির খামারি বলেন, একটা সময় এ ব্যবসা লাভজনক ছিল। বর্তমানে যে হারে খাবারের দাম বেড়েছে, খামার চালানোই দুষ্কর।
দৌলতপুরের রহিম মিয়া বলেন, দীর্ঘ আট বছর ধরে লেয়ার মুরগি ও ডিমের ব্যবসা করেছি। ১০০ টাকায় ৭০ টাকা খরচ হয় মুরগির খাবারে। লাভ এর থেকে লোকসান বেশি হওয়ায় ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ অর্থবছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ সময়ে মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ভোক্তারা।
সিন্ডিকেট নয়, খাবার খরচ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারনে ডিম উৎপাদন কমেছে বলে মন্তব্য করেন খুলনা বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ডা. নুরুল্লাহ মোহাম্মদ আহসান। তিনি বলেন, বিগত চার থেকে পাঁচ মাস ধরে ১২ টাকার ডিম ১০ টাকায় বিক্রি করছে খামারিরা। খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, প্রতিটি ডিমে দুই টাকা করে লোকসান দিয়েছে তারা। এছাড়া বছরে ৮ মাস এ সকল খামারিরা লোকসানে থাকে। যার কারণে বেশ কয়েকটি খামারি বন্ধ করে দিয়েছে খামার।
ডিমের দাম নির্ধারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সরকারি কয়েকটি খামারে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। বেসরকারিসহ অন্যান্য খামারিদের মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। শীঘ্রই তা বাস্তবায়ন হবে।
তবে সিন্ডিকেটের এই কালো হাত ভাঙতে এবং খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ক্রেতারা।