খুলনার অধিকাংশ অফিসে ঝুলছে তালা : সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিস্তর অভিযোগ
# কমিউনিটি পুলিশিং এলাকার গণ্যমান্যদের কমিটিতে রাখার কথা থাকলেও আ’লীগের নেতারাই দখলে রেখেছিল #
সাইফুল্লাহ তারেক ঃ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কার্যক্রমে জনগণের অংশীদারত্ব তৈরি করা ছিল কমিউনিটি পুলিশিংয়ের লক্ষ্য। অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থার লক্ষ্যে ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’ এ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের। তবে শুরু থেকেই পুলিশের এ সামাজিক উদ্যোগ পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই কমিউনিটি পুলিশিংয়ে যুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধে সংশ্লিষ্টতার নানা অভিযোগ ওঠে। এমনকি কারও কারও বিরুদ্ধে , নির্যাতন ও চাঁদাবাজি জমি দখলের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে।
আর এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, এলাকার অরাজনৈতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিতে রাখার কথা থাকলেও আদৌ তা হয়নি। প্রথম থেকেই প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই ছিল কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটির নিয়ন্ত্রক। যে কারণে তেমন সফলতার মুখ দেখেনি পুলিশের এসামাজিক উদ্যোগ। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঠপর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এক কথায় বলা যায় ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে কমিউনিটি পুলিশিং। খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে থাকা কমিউনিটি পুলিশের অফিসগুলোতে ঝুলছে তালা। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে কেএমপির পক্ষ থেকে চেষ্টা করছে কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে আবার শুরু করার। সংশ্লিষ্টরা বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম শুরুতেই পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের হস্তক্ষেপে বিরোধ মিটিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। এই উদ্যোগকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় পুলিশ বাহিনী। বর্তমানে সারা দেশে কমিউনিটি পুলিশের কমিটির সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫২৯টি। আর কমিটির সদস্য ৮ লাখ ৯৪ হাজার ২০৬ জন। এলাকাভিত্তিক বিটের সংখ্যা ৬ হাজার ৫২৫টি। কমিউনিটি পুলিশিং একটি সাংগঠনিক দর্শন ও ব্যবস্থাপনা, যা জনগণকে সম্পৃক্ত করে। জনগণ, সরকার ও পুলিশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই কার্যক্রম অপরাধ দমন ও সমস্যার সমাধানকল্পে অপরাধের কারণ দূরীকরণ, অপরাধ প্রবণতা হ্রাস ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘শান্তি-শৃঙ্খলা সর্বত্র’। কমিউনিটি পুলিশ সদস্যর ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে সমাজকে নিরাপদ রাখবে এমনটাই আশা পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের। কিন্তু তাদের ভালো কাজের মধ্যে কিছু সদস্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা হন বিব্রত।
জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহে প্রথম কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ থানা পুলিশের হয়ে ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে। কমিউনিটি পুলিশের অফিসগুলো তালাবদ্ধ থাকত বেশিরভাগ সময়ই। মাঝেমধ্যে খুললে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আড্ডাস্থলে পরিণত হতো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও কমিউনিটি পুলিশের সদস্যরা বিরোধিতা করে দমনপীড়ন চালায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনারের পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থানা পুলিশের পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আস্তে আস্তে থানার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম গতিহীন হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই কমিউনিটি পুলিশের নিয়ন্ত্রক ছিল উল্লেখ করে কেএমপির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যে উদ্দেশ্য এই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল তার প্রতিফলন হয়নি। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কমিটিতে রাখার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতারাই দখলে রেখেছিল। বর্তমানে কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম নেই। অতিদ্রুত এ কার্যক্রম শুরু হবে। এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। তারা সামাজিকভাবে কাজ করেন। প্রতিটি সদস্যের ওপর নজরদারি করে থানা-পুলিশ। আর মহানগর পুলিশ কমিশনার ও জেলার এসপিরা তাদের কর্মকান্ড তদারকি করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে কমিউনিটি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই কমিউনিটি পুলিশিংয়ে যুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। কারও কারও বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও জমি দখল , ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আছে। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে ছিল চাপ। সরেজমিনে দেখা গেছে, খুলনার কমিউনিটি পুলিশের বেশিরভাগ অফিস তালাবদ্ধ। প্রতিমাসে একবার বৈঠক করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের প্রায় সবাই এখন আত্মগোপনে।