স্থানীয় সংবাদ

শেখ বাড়ির নাম ভাঙ্গিয়ে খুলনা পলিটেকনিট ইনস্টিটিউটের সাবেক স্টোর কিপার নাসির এখন কোটিপতি

সকল অনিয়মই ছিল তার কাছে নিয়ম

খলিলুর রহমান সুমন ঃ খুলনার শেখ বাড়ির আস্থাভাজন খুলনা পলিটেকনিট ইনস্টিটিউটের সাবেক স্টোর কিপার (বর্তমান গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক) নাসির উদ্দীন এখন কোটিপতি বনে গেছেন। ঝিনাইদহে বাড়ি হলেও সাধারণ একজন কর্মচারি খুলনায় একাধীক গাড়ি বাড়ির মালিক। শেখ বাড়ির নাম ভাঙ্গিয়ে সকল অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন। আ’লীগের আমলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাকে খুবই সমিহ করতেন। তার অন্যায় আবদার ভয়ে বাধ্য হয়ে সহজেই মেনে নিতেন সকলে। এক বছরে চার প্রতিষ্ঠানে বদলী হয়ে সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছেন। সরকারি চাকুরি করেও অনুমতি ছাড়া নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে বেসরকারি পলিটেকটিক থেকে তারই প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেন নকল করে। যার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সমপদে বদলী কার হয়। খুলনার অভিজাত এলাকা সোনাডাঙ্গার আরামবাগ এলাকায় গড়ে তুলেছেন সুরম্য অট্টালিকা। তিনি একাধারে খুলনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দীন জুয়েলের এপিএস সাঈদ ও ৩ আসনের সাবেক সদস্য সদস্য এস এম কামালের এপিএস সোহেল বিশ্বাসের সাথে বন্ধুর মত চলাফেরা করতেন। শেখ সোহেলের সাথে তার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলে তিনি প্রচার করে বেড়াতেন। সব মিলিয়ে শেখ বাড়িসহ খুলনার আ’লীগের বড় বড় নেতাদের কাছে লোক হিসেবে তিনি পরিচয় দিতেন।
নাসির উদ্দীনের সার্ভিস বুক (এসিআর) বইয়ের দু’টি পৃষ্ঠা ছেড়া অবস্থা নিজে এনে তা খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে জমা দেন। তিনি তার দ্বিতীয় নাম্বার সার্ভিস বুকের ৩য় ও ৪র্থ নং পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলে চাকুরি বিধি মালা লংঘন করেছেন। ওই দু’টি পৃষ্ঠায় খুলনা মহিলা পলিটেকনিকের অনিয়ম করার বিষয় লিপিবদ্ধ ছিল। যা গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষ অনেহা প্রকাশ করে। তারপরও তিনি তার এসিআর বই জমা দেন। এই বই ডাকযোগে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নিকট আসার নিয়ম রয়েছে। এটা অনেক গোপন বিষয় হলেও নাসিরের কাছে সবই ওপেন। বিগত দিনে শেখ বাড়ির নাম ভাঙ্গিয়ে নিজে কলেজে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এই ক্ষমতা বলে তিনি একই বছরে চারবার বদলী হয়েছেন। অন্যায় করলে তাকে বদলী পর্যন্ত শাস্তি শেষ। অবৈধ ক্ষমতার কারণে তার বেশী শাস্তি তাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে সাহস পেতেন না।
স্টোর কিপার হিসেবে তিনি একই বছরে চার জায়গায় বদলী হয়েছেন। যা অস্বাভাবিক। তিনি আ’লীগ আমলে শেখ বাড়ির ভয় দেখিয়ে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তার পদ অনুযায়ী যেখানে যাওয়ার কথা নয় তিনি সেখানে গিয়ে খবরদারি করতেন। কথায় কথায় শেখ বাড়ির ভয় দেখাতেন। সামান্য বেতনে চাকুরি করেই তিনি বিলাশ বহুল জীবন যাপন করেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে হলেও তিনি খুলনায় একাধীক ভবনের মালিক বনে গেছেন।
এদিকে স্টোর কিপার নাসির উদ্দীনের পরীক্ষার প্রকাশিত ফল বাতিল করার জন্য কলেজের অধ্যক্ষ অনিমেশ পাল বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট গত ২৮ জুলাই চিঠি প্রেরণ করেছেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, “অত্র ইনস্টিটিউটের স্টোর কিপার মোঃ নাসিরউদ্দিন কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বেসরকারি পলিটেকনিক বৈকালীস্থ ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে পরীক্ষা প্রদানকালে অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। গত ৬ আগস্ট’২৪ ছাত্রদের ধারণকৃত ভিডিও চিত্র প্রত্যক্ষ করে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ মোঃ নাসিরউদ্দিনকে তাৎক্ষণিকভাবে গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সমপদে বদলি করেন। মোঃ নাসির উদ্দিনের নকলরত অবস্থায় প্রকাশিত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল চর্চিত হওয়ায় ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রমের মানহানি হচ্ছে। এমতাবস্থায় তার প্রকাশিত ফলাফল বাতিলসহ রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের সুপারিশ করা হলো।”
এদিকে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হয়ে গত মে-জুলাই, ২০২৪ মাসে অনুষ্ঠিত অত্র ইন্সটিটিউট কেন্দ্রে বোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন, যা চাকরি বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। এ জন্য তাকে গত ৩০ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন কর্তৃপক্ষ। ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়, “আপনি (নাসির) একই সময়ে/তারিখে- পরীক্ষার দিনে কর্মচারী হাজিরা বহিতে স্বাক্ষর করেছেন। পরীক্ষায় শিক্ষার্থী হাজিরা সীটে স্বাক্ষর করেছেন। উক্ত পরীক্ষা বাবদ আপনার পদের সম্মানী গ্রহণ করেছেন। এহেন নিয়ম বহির্ভূত কাজের জন্য অসদাচরণের দায়ে কেন আপনার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার সুস্পষ্ট লিখিত জবাব আগামী তিন কার্যদিবসে অফিস চলাকালীন সময়ের মধ্যে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের নিকট দাখিলের নির্দেশ দেয়া হলো। প্রশাসনিক-কাম-একাডেমিক পরিষদের সভার প্রারম্ভে সভাপতি সকলকে স্বাগত জানিয়ে গত ২৫ জুলাই সকাল সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কাম-একাডেমিক পরিষদের সদস্য বৃন্দের উপস্থিতিতে অধ্যক্ষ প্রকৌশলী অনিমেশ পালের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আটটি সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, অত্র ইনস্টিটিউটের স্টোর কিপার মোঃ নাসির উদ্দিন অত্র ইনস্টিটিউটের সরবরাহকারীদের নিকট বিল ছাড়ার সময় মোটা অংকের টাকার জোর পূর্বক আদায় করে বিল-ভাউচার ছাড়ার ব্যবস্থা করে যা ঠিকাদারগণ সভায় উপস্থিত হয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। ইনস্টিটিউটের স্টোর শাখার গোপনীয় নথি ফটোকপি করে স্টোর কিপার মোঃ নাসির উদ্দিন বিভিন্ন ঠিকাদারদের নিকট হতে অর্থ আদায় করেছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ইনস্টিটিউটের গোপনীয়তা রক্ষা করা যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মোঃ নাসির উদ্দিন বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী হিসেবে খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি পরীক্ষার কক্ষে অসদুপায় অবলম্বন করেছেন মর্মে অন্য শিক্ষার্থীরা প্রমাণক দাখিল করেছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট তারা বিচার প্রার্থী। নাসির উদ্দিনকে অভিযোগের কথা বললে সে সমন্বয়কসহ দুদকে মামলা দিবে বলে সকলকে হুমকি দিয়ে থাকে। নাসির উদ্দিন চাকুরীরত অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন সময়ে শেখ পরিবারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সাথে তার সখ্যতা আছে ও তাদের সাথে তার ছবি দেখিয়ে ভয় ভীতি দেন। নাসির উদ্দিন কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এ তার পরিচিতি আছে মর্মে অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলী ও পদোন্নতি সংক্রান্ত তদবির করে থাকেন। হাতিয়ে নেন অনেক টাকা। অত্র ইনস্টিটিউট এর বর্জ্য ও বর্জিতাংশ নিলাম কালে নাসির উদ্দিন নিলাম সংক্রান্ত ওজন পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদনের দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু তিনি প্রকৃত প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এছাড়াও নিলাম ক্রয়কারী ঠিকাদারের নিকট হতে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সকলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তিতে তিনি এই ধরণের অপরাধ করলে কিংবা অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে কর্তৃপক্ষের গোচরে আনাসহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারিগরি শিক্ষ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী অনিমেশ পাল বলেন, সদ্য বদলীকৃত প্রতিষ্ঠানের স্টোর কিপার নাসির উদ্দীন প্রতিষ্ঠানে অনুমতি না নিয়ে অন্য পলিটেকনিকের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে তারই প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছেন। একই সাথে তিনি পরীক্ষায় নকল করেছেন। যার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের চাপের কারণে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানালে তাদের নির্দেশে নাসির উদ্দীনকে গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সম পদে বদলী করা হয়েছে। খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক স্টোর কিপার নাসির উদ্দীন বলেন, আমি একজন সাধারণ কর্মচারি মাত্র। ব্যাংকের লোন আর শ্বশুড় বাড়ির সহায়তায় খুলনা নগরীর আরামবাগে দ্বিতীয়তলার একটি বিল্ডিং করা হয়েছে। অফিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা চাইছেন তাই আমাকে এক বছরে চারবার বদলী করেছেন। আমি বেসরকারি কলেজ থেকে খুলনা পলিটেকনিক কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছি। নকল করার প্রশ্ন আসে না। আমি শুধু একা নই, এই প্রতিষ্ঠান থেকে আরো অনেকে পরীক্ষা দিয়েছে। কেউ তো কর্তৃপক্ষে অনুমতি নেয়নি। তাদের কিছু হলো না, আমাকে জবাব দিহিতা করতে হবে। এটা কেমন আইন। আমি তো বিকেলে পরীক্ষ দিয়েছি। আর আমাকে কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শানোর কোন নোটিশ করেনি। এসিআর বই ঢাকা থেকে অনেকে নিজ হাতে নিয়ে আসে। সেইভাবে আমাকে উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা দিয়েছে। আমি হাতে করে এনে খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের নিকট জমা দেই। আমার এসিআর বইয়ের পাতা ছেড়ার অভিযোগ সত্য নয়। আমি সামাজিক লোক। সমাজপতিদের সাথে সুসম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে বদলী ও নিয়োগ বাণিজ্য করেছি-এটা ঠিক নয়। আমি তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি এ কথা সত্য নয়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button