স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ‘বীর নিবাসে’ কোটিপতিদের বসবাস!

ক্ষমতার দাপটে নকশা পরিবর্তন করে আলিশান ভবন নির্মাণ
নাম ফলক মাটি ও পলিথিন দিয়ে ঢাকা

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : নাহিদা আক্তার ইলা, গৃহবধূ। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে। বড় বোন ওয়াহিদা আক্তার শিলা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সচিব। কর্মরত ছিলেন পলায়নকৃত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী-২ হিসেবে। ছোট বোন লতিফা আক্তার নিলাও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। এ তিন কন্যার পিতা মৃত, নজীর আহম্মদ। সকলেই অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। ইলা’র একমাত্র পুত্র রিশাদুল ইসলামও ঠিকাদার।
অথচ: পিতার সুবাদে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে কন্যা নাহিদা আক্তার ইলা’র নাম। নিয়েছেন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’ নামক বাড়ীও। এমনকি ঠিকাদারকে কাজ করতে না দিয়ে নিজেরাই নকশা পরিবর্তন করে ইচ্ছামত সরকারি অর্থে নির্মাণ করছেন বহুতল বিশিষ্ট আলিশান ভবন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন এবং মার্কেটও তৈরি করেছেন। যদিও ক্ষমতার পট পরিবর্তন এবং ক্ষমতার উৎস্য সচীব বোনের চাকরিচ্যুতি ও আত্মগোপনের পর ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি কাঁদা মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। যেন দেখে কেউ কিছু বুঝতে না পারে।
একইভাবে উপজেলার চন্দনীমহল গ্রামের গাজী আব্দুল লতিফের একমাত্র পুত্র গাজী লুৎফর রহমানও ‘বীর নিবাস’র নকশা পরিবর্তন করেছেন। তিনি কর্মরত রয়েছেন বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ষ্টার জুট মিলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বিশাল মার্কেট ও তিনটি বাড়িসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। মা মর্জিনা বেগমের নামে বরাদ্দ হলেও তিনিই পিতা’র অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’র অধিবাসী। শিলা-নিলা’র ভাইয়ের বন্ধু পরিচয়ধারী এই লুৎফরও ক্ষমতার দাপটে নকশা পরিবর্তন করে আলিশান বাড়ি তৈরি করতে ঠিকাদারকে বাধ্য করেছেন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন এবং মার্কেট তৈরি করে তিনিও ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। যা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এটা ‘বীর নিবাস’।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’র এমন তুঘলকি চিত্র খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার। উপজেলার ১২জন মুক্তিযোদ্ধা ‘বীর নিবাস’ পেয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতার দাপটে উল্লিখিত দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ এভাবে ইচ্ছামাফিক নয়-ছয় করেছেন। নিয়ম-নীতির কোন তোয়াক্কা না করে সরকারি অর্থে নির্মিত বাড়িকে ‘নিজের বাড়ি’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অথচ: বীর নিবাসে ঠাঁই হয়নি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই-বাছাইতে বাদ পড়েন পিতা নজীর আহম্মদ। কিন্তু প্রভাবশালী দু’ কন্যা ওয়াহিদা আক্তার শিলা ও লতিফা আক্তার নিলা’র ক্ষমতার দাপটে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)’র তালিকায় ২০১০ সালে তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গেজেটভূক্ত করানো হয়। পরবর্তীতে উপজেলার ১২জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার তালিকার ৬নং ক্রমিকে নাম অন্তর্ভূক্ত করিয়ে ‘বীর নিবাস’ নামক বাড়ি বরাদ্দ করানো হয়। আর তালিকার ১১নং ক্রমিকে রয়েছে শিক্ষক গাজী লুৎফরের মা মর্জিনা বেগমের নাম। তবে তারা অসচ্ছল তালিকায় সরকারি বাড়ি পেলেও সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষার কৌশল হিসেবে নামফলকগুলো আড়াল করে ফেলেছেন। সরেজমিনে ঘুরে এসব নানা অনিয়মের দৃশ্য চোখে পড়েছে।
উপজেলার সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা শিবনাথ রায়ের আমল থেকে তালিকায় নাম তোলার চেষ্টা করে আসছিলেন নাহিদার পিতা নজির আহমেদ। কিন্তু সঠিক কাগজপত্র ও প্রমাণাদি না থাকায় উপজেলার যাচাই-বাছাইতে তার নাম বাদ পড়ে। এমনকি দু’ প্রভাবশালী কন্যার মামা মুন্সী মাহবুবুর রহমান (হাবিবুর রহমান) কেও মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পায়তারা করেন তারা। ওই সময় তার মেঝ বোন ইলা’র ছেলে রাশেদুল একটি চিঠি দেখিয়ে এলাকায় প্রচার করে তার নানা’র নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসছে। এমনকি মাহবুবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত হচ্ছেন- মর্মে নিজেই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।
এ বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলার ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আসগার আলী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাচাইতে শিলা-নিলার পিতা নজির আহমেদের মুক্তিযোদ্ধার নাম আসেনি। তার নাম জামুকার তালিকায় গেজেট হয়ে আসে। তিনি মন্তব্য করেন, নাহিদা আক্তার ও মর্জিনা বেগম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাস’র ঘর পাওয়ার যোগ্য না। তারা নকশা পরিবর্তন করেছে, এটা ঠিক করেনি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কামরুজ্জামান বলেন, উপজেলায় নাহিদা আক্তারের ঘরটা নকশা ছাড়া আলিশান বাড়ি করা হয়েছে। আর সামনে মার্কেট থাকার কারণে গাজী লুৎফরের মা মর্জিনা বেগমের বাড়ি দৃশ্যমান হয়নি।
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নাহিদা আক্তার বলেন, প্রথমে সরকারী নকশা অনুযায়ী ‘বীর নিবাস’ তৈরি করা হয়। পরে সবার সাথে কথা বলে আমার ছেলে রাশিদুল ইসলাম ওই বাড়ি ভেঙ্গে আবার নতুন ভবন তৈরি করে। ঘরের অনেক কাজ বাদ আছে। ঘরে বসবাস করার মত এখনও হয়নি। সরকার থেকে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে তো ঐ বাড়ি তৈরি হয় না। আমি এ বিষয়ে বেশি কিছু জানিনা। সব আমার ছেলে করেছে। ছেলে রাশিদুলের সাথে কথা বললে সব কিছুই জানতে পারবেন বলেও তিনি জানান।
অপর ‘বীর নিবাস’র নকশা পরিবর্তনকারী মর্জিনা বেগমের ছেলে গাজী লুৎফর এ বিষয়ে নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাসুম বিল্লাহ বলেন, তিনি উপজেলায় যোগদানের আগেই বীর নিবাস’র জন্য যাচাই-বাছাই হয়েছে। তবে যারা ‘বীর নিবাস’র নকশা পরিবর্তন করে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছে তাদের নোটিশ করা হবে। তারা কেন নকশা পরিবর্তন করেছে তা জানতে চাওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button