স্থানীয় সংবাদ

খুলনায় ‘বীর নিবাস’র অনিয়মের সংবাদে তোলপাড় : টনক নড়েছে প্রশাসনের

কারণ দর্শাতে দু’ পরিবারকে নোটিশ
দৈনিক প্রবাহে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ঃ খুলনার দিঘলিয়ায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত বাড়ি ‘বীর নিবাস’র নকশা পরিবর্তন করে আলিশান ভবন নির্মানসহ নানা অনিয়মের ঘটনায় দৈনিক প্রবাহে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে টনক নড়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট দু’টি পরিবারকে কারণ দর্শাতে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। রোববার (০৩ নভেম্বর) দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মাসুম বিল্লাহ স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। অনিয়মের তথ্যের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার বিষয়টিও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো: মাসুম বিল্লাহ এ প্রতিবেদকে বলেন, সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শানোর জন্য নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিধি অনুযায়ী যা যা করণীয় সব কাজই চলমান রয়েছে।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর অনলাইন দৈনিক প্রবাহে ‘খুলনায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীর নিবাসে’ কোটিপতিদের বসবাস’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত বাড়ি ‘বীর নিবাস’র নকশা পরিবর্তন করে আলিশান ভবন ও বাড়ি লাগোয়া মার্কেট নির্মানসহ নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। এ সংবাদ প্রকাশের পরই প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এমনকি ওই সংবাদের বস্তনিষ্ঠ তথ্যে প্রকৃত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারাও অনিয়মকারীদের বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উপজেলার সেনহাটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত শেখ নজির আহম্মেদ’র কন্যা নাহিদা আক্তারকে প্রদানকৃত ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ প্রকল্পে নকশা পরিবর্তনের কারন দর্শানো’ শিরোনামে দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মাসুম বিল্লাহ স্বাক্ষরিত নোটিশে উল্লেখ করা হয়, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং সরেজমিনে পরিদর্শন উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দিঘলিয়া উপজেলাধীন অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তন্মধ্যে অনুমোদিত তালিকায় ক্রমিক নং-০৬, উপকারভোগী- নাহিদা আক্তার, পিতা- বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত শেখ নজির আহম্মেদ, সেনহাটি, দিঘলিয়া, খুলনাকে ২০২৩ সালের ২৫ মে বীর নিবাস হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর বীর নিবাসের নকশা পরিবর্তন করার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারীর নির্দেশিকা অনুযায়ী নির্মিত বাসস্থানের মূল অবকাঠামোগত কোন পরিবর্তন/পরিবর্ধন/উর্দ্ধমুখী সম্প্রসারণ করা যাবে না- মর্মে নির্দেশনা আছে। কিন্তু বীর নিবাসটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে নকশা পরিবর্তনের বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। যা নির্দেশিকার সুস্পষ্ট লংঘন ও পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ‘অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য আবাসন এর বরাদ্দ, ব্যবহার এবং রক্ষনাবেক্ষণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা মোতাবেক বীর নিবাসের নির্দেশিকা লংঘনের জন্য আপনার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না- তার সুনির্দিষ্ট জবাব আগামী ০৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে নি¤œস্বাক্ষরকারীর কার্যালয়ে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। অপর বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল লতিফের স্ত্রী মর্জিনা বেগমকেও একই নোটিশ প্রদান করা হয়।
প্রসঙ্গত, উপজেলার সেনহাটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত শেখ নজির আহম্মেদ’র কন্যানাহিদা আক্তার ইলা। তার বড় বোন ওয়াহিদা আক্তার শিলা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সচিব। কর্মরত ছিলেন পলায়নকৃত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী-২ হিসেবে। তার ছোট বোন লতিফা আক্তার নিলা একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার উপ-পরিচালক। এ তিন কন্যার সকলেই অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। ইলা’র একমাত্র পুত্র রিশাদুল ইসলামও ঠিকাদার। অথচ: পিতার সুবাদে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাহিদা আক্তার ইলা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’ বাড়ী বরাদ্দ পান। তবে ঠিকাদারকে কাজ করতে না দিয়ে নকশা পরিবর্তন করে ইচ্ছামত সরকারি অর্থে নির্মাণ করছেন বহুতল বিশিষ্ট আলিশান ভবন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন এবং মার্কেটও তৈরি করেছেন। যদিও ক্ষমতার পট পরিবর্তন এবং ক্ষমতার উৎস্য সচীব বোনের চাকরিচ্যুতি ও আত্মগোপনের পর ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি কাঁদা মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন।
একইভাবে উপজেলার চন্দনীমহল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল লতিফের একমাত্র পুত্র গাজী লুৎফর রহমান কর্মরত রয়েছেন বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ষ্টার জুট মিলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বিশাল মার্কেট ও তিনটি বাড়িসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। মা মর্জিনা বেগমের নামে বরাদ্দ হলেও তিনিই পিতা’র অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’র অধিবাসী। শিলা-নিলা’র ভাইয়ের বন্ধু পরিচয়ধারী লুৎফরও ক্ষমতার দাপটে নকশা পরিবর্তন করে আলিশান বাড়ি তৈরি করতে ঠিকাদারকে বাধ্য করেছেন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন এবং মার্কেট তৈরি করে তিনিও ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। যা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এটা ‘বীর নিবাস’।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’র এমন তুঘলকি চিত্র খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার। উপজেলার মাত্র ১২জন মুক্তিযোদ্ধা ‘বীর নিবাস’ পেয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতার দাপটে উল্লিখিত দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ এভাবে ইচ্ছামাফিক নয়-ছয় করেছেন। নিয়ম-নীতির কোন তোয়াক্কা না করে সরকারি অর্থে নির্মিত বাড়িকে ‘নিজের বাড়ি’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অথচ: বীর নিবাসে ঠাঁই হয়নি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button