খুলনার ভোক্তা অধিকার যেন ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’

দায়সারা অভিযান, জরিমানার পরিবর্তে মিমাংসায় নজর বেশি
রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার
কামাল মোস্তফা ঃ বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’। প্রবাদটি খুলনার ভোক্তা অধিকার নামক সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জেলার নয়টি উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন মিলে প্রায় ২৭ লাখ মানুষের ভোক্তা অধিকার দেখার জন্য লোকবল হিসেবে রয়েছে মাত্র দু’জন। এর মধ্যে একজন সহকারি পরিচালক ও একজন অফিস সহকারি। খুলনা শহরসহ শহরতলীর নির্দিষ্ট কিছু অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করে বলে অভিযোগ রয়েছে ভোক্তা অধিকারের বিরুদ্ধে। যার পুরোটাই যেন দায়সারা গোছের।
সূত্র মতে, চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ৩১টি অভিযোগ জমা পড়েছে জেলা জেলা ভোক্তা অধিকারের দপ্তরে। যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২১টি। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১০টি। এসব অভিযোগের বেশিরভাগই ছিল মোবাইল, টিভি ও সুপার শপের বিরুদ্ধে। ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে কোন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা না করে বাদি বিবাদীর সম্মতিতে মীমাংসা করা হয়েছে। ফলে রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। অভিযোগ ছাড়াও নিজ উদ্যোগে গেল জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বাজার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ৬৯টি। তাদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ আদায় হয়েছে ৭ লাখ ১ হাজার ৫শ’ টাকা। জানা যায়, অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হয় কসমেটিকস, মাংসের বাজার, মিষ্টির দোকান, নিত্যপণ্যের বাজার, খাবারের হোটেল, বেকারি, ফার্মেসীসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানকে। গেল সাড়ে পাঁচ মাসে ৬৯টি অভিযানের বেশিরভাগই ছিল খুলনা মহানগরীতে। কিছু অভিযান খুলনার বাইরে- যেমনঃ ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, তেরখাদা, ফুলতলা ও পাইকগাছায় করা হয়েছে। তবে এই দীর্ঘ সময়ে কয়রা ও দাকোপ উপজেলায় পা দেননি ভোক্তা অধিকারের কর্তা-ব্যক্তিরা। ভোক্তাদের অভিযোগ, ভোক্তা অধিকার লোক দেখানো অভিযান করে। ৫-৬ টা প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র জরিমানা করে অভিযান শেষ করে। তাদের বেশিরভাগ অভিযান শহর কেন্দ্রিক। উপজেলাগুলোতে যাননা বললেই চলে, কালে-ভদ্রে গেলেও অভিযান চলে দায়সারা। এই মুহুর্তে দাম বেড়ে যাওয়া আলু, ডিমের বাজারে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। খামারি যারা বেশি দামে ডিম বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করা দরকার। তা না করে তারা কিছু খুচরা দোকানে অভিযান চালিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাননা বললেই চলে। হয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের অলিখিত লেনদেন অথবা তাদের কাছে খুলনায় কর্মরতরা জিম্মি হয়ে আছেন। ভোক্তাদের জিম্মি করে প্রতি মুহুর্তে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অথচ: সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি থেকেও কার্যত ভোক্তাদের কোন কাজে আসছে না বলেও মন্তব্য অনেকের। আবার ভোক্তারা অভিযোগ করলেও অনেক ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা না করে এড়িয়ে যাওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। কয়রার গোবরা দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মেসবাহ উদ্দিন বলেন, কয়রাতে আমি কখনো ভোক্তা অধিকারের কাউকে দেখিনি। সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় এখানে মধু আহরণ হয়। প্রতিনিয়ত মধুতে ভেজাল মিশ্রণ করা হয়, যাতে প্রতারিত হয় মানুষ। কিন্তু এগুলো দেখবে কে- প্রশ্ন করেন তিনি। খুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন আরিফ রহমান। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা ঠকছি, প্রতিনিয়ত ভেজাল খাচ্ছি। কিছু বাজার, মিষ্টির দোকান, ওষধের দোকানে অভিযান করলে হবে না, এদের যারা নিয়ন্ত্রণ করে সেই সব বড় ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন সিসিএসের যুব সংগঠন সিওয়াইবির খুলনা বিএল কলেজ শাখার সভাপতি রহমাতুল্লাহ বলেন, মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার আইন লংঘনে মৃত্যুদন্ডের পর্যন্ত বিধান রয়েছে। কিন্ত তার প্রয়োগ নেই। ভোক্তার অধিকার নিশ্চিতে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। লোক দেখানো অভিযান করা অসৎ ব্যবসায়ীদের সুড়সুড়ি দেয়া একই কথা।
জেলা ভোক্তা অধিকার খুলনা জেলার সহকারি পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিব বলেন, আমাদের জনবল সংকট থাকলেও সপ্তাহে ৭ দিন বা অন্তত ৫ দিন অভিযান পরিচালনা করি। কোন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানোর পর পরবর্তীতে সেখানে আবার ফলোআপ করা হয়। ইচ্ছা থাকলেও সব জায়গায় যাওয়া হয়না নানান প্রতিকূলতার কারণে। তবে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।