খুবিতে অতিরিক্ত ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের অসন্তোষের অবসান

কমানো হলো দু’ দফায়
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান : খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিসিপ্লিন কর্তৃক আবাসিক-অনাবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ও কোন কোন ক্ষেত্রে বলপূর্বক ফি আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। বিষয়টি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাদের দাবি ছিল- অতিরিক্ত ফি কমানো এবং বলপূর্বক ফি আদায় বন্দের। তবে, রাজনৈতিক ভিসি-প্রশাসন থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি- কর্তৃপক্ষ দাবি পূরণের উদ্যোগ নেননি।
এদিকে, গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং খুবি প্রশাসনের পরিবর্তনের পর শিক্ষার্থীরা আবারও দাবি তোলেন ফি কমানোর। যার প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ ১৩ ও ১৭ নভেম্বর দু’ দফায় বিভিন্ন খাতে ফি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শোনা গেছে। কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেও অনেকেই আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের খাত এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ফি কমানোর দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা প্রতি সেমিস্টারে ডিসিপ্লিন উন্নয়ন চার্জ, নবীন বরণ, পিকনিক, বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষা সফরের নামে বলপূর্বক ফি আদায় বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বাস ভাড়া বাবদ প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে বছরে ১৮০০ টাকা গ্রহণ করা হত। কিন্তু বাস সার্ভিস খুব অপ্রতুল। এক্ষেত্রে আবাসিক- অনাবাসিক সকল শিক্ষার্থীর বাস ভাড়া দেওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারে ডিসিপ্লিন কর্তৃক ৫শ’ টাকা হারে ডিসিপ্লিন উন্নয়ন চার্জ গ্রহণ, নবীন বরণের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা বাধ্যতামূলক আদায়, প্রতিবছর পিকনিকের নামে ডিসিপ্লিনগুলোতে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৭শ’ থেকে ১ হাজার টাকা করে জোরপূর্বক আদায়, বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষা সফরে বরাদ্দের বাইরেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জোরপূর্বক আদায় করা হয়। সম্প্রতি সমাজ-বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কক্সবাজার শিক্ষা সফরের জন্য বরাদ্দের বাইরেও ১০ হাজার টাকা করে শিক্ষকরা জোরপূর্বক আদায় করেছেন বলেও অভিযোগ কোন কোন শিক্ষার্থীর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, বিভিন্ন ডিসিপ্লিন কর্তৃক আয়োজিত এ সকল শিক্ষা সফর এবং পিকনিক শিক্ষার্থীদের অর্থ দিয়ে করা হলেও শিক্ষকরা স্বপরিবারে ভ্রমণ করে থাকেন। এই সকল বলপূর্বক অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে কোন ধরণের আপত্তি বা অস্বীকৃতি জানালে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়াসহ শিক্ষকদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের হুমকির শিকার হতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা খুবি সংস্কারে ৩৭ দফা দাবি উত্থাপন করে কর্তৃপক্ষের কাছে। শুরু হয় আন্দোলন। যার প্রেক্ষিতে ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় কয়েকটি খাতের ফি কমানো হয়। এর মধ্যে স্নাতক/স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন কোর্স ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ওয়েল ফেয়ার ফি ১৫০, বিএনসিসি ৫০, কালচারাল ১৫০, লাইব্রেরী ১শ’, প্রকাশনা ১শ’, ধর্মীয় ১শ’, মেডিক্যাল ১৫০, স্পোর্টস ১৫০, কোর্স রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার, পরীক্ষার ফি ৪শ’ এবং পরিবহন খাতে ৯শ’ টাকা হিসেবে মোট ৩ হাজার ২৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে মাস্টার্স শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ খাতে একই থাকলেও কোর্স রেজিস্ট্রেশন ফি ২ হাজার এবং পরিবহন খাতে ৫শ’ টাকা নির্ধারণ করে মোট ৩ হাজার ৮১০ টাকা করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে ফের আন্দোলন শুরু করে।
সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর খুবি’র রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. এসএম মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে দ্বিতীয় দফায় স্নাতকের কোর্স রেজিস্ট্রেশন ফি ৪০, এক্সাম ২০ এবং পরিবহন খাতে ৬শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে মাস্টার্স শ্রেণির কোর্স রেজিস্ট্রেশন ফি ৭৫, এক্সাম ২০ পরিবহন খাতে ৬শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া আবাসিকের জন্য হল ৫শ’, পরবর্তী কোর্স ফি যথাক্রমে ২৫০ ও ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে অনাবাসিকের জন্য হল ফি ২৭৫ টাকা করা হয়েছে। উল্লিখিত ফি স্নাতক/স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষ এবং মাস্টার্স শ্রেণির জন্য ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ফি কমানোয় সন্তোষ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. একরামুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের অর্থ সংক্রান্ত দাবিগুলো পূরণ হয়েছে। এর বাইরেও তাদের আরও দাবি রয়েছে। তবে ডিসিপ্লিন কেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়ের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিনের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদেরই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ইংরেজি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের অপর শিক্ষার্থী আয়মান আহাদ বলেন, রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত দাবিগুলো পুরণ করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অন্যান্য দাবিগুলো এখনও অপূর্ণ রয়েছে। বিশেষ করে জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে কোন অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা আবারও কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এছাড়া বিভিন্ন ডিসিপ্লিন কেন্দ্রিক ভিন্ন ভিন্ন খাতে কোন শিক্ষার্থীর কাছ থেকেই জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা উচিত নয়- উল্লেখ করে তিনি এর একটা অবসান দাবি করেন।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক পরিচালক প্রফেসর ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, ফি সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সকল দাবি পুরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে ডিসিপ্লিন কেন্দ্রিক অর্থ আদায় সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ম্যানেজমেন্টের বিষয়। তারা তাদের নিজস্ব কর্মসূচি অনুযায়ি ফি আদায় করে থাকে। এটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিষয় না।