খুলনায় এখনো পলিথিনের ব্যবহার চলছে ‘চুপিসারে’

# পলিথিন বন্ধে মোবাইল কোর্টে ৩৬ প্রতিষ্ঠানকে অর্থদ-, জব্দ করা হয়েছে ২১৬২ কেজি পলিথিন #
# নাগরিক নেতারা বলছেন ঃ পলিথিন বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ উৎপাদনের কারখানা বন্ধ করা উচিত #
মো. আশিকুর রহমান ঃ পলিথিন একটি নন-বায়োডিগগ্রেটেবল বস্তু যা সহজে পচনশীল নয়। পলিথিন অপচনশীল হওয়ার দরুন বছরের পর বছর মাটির নীচে থাকার পরও নষ্ট হয় না। পলিথিন মাটির সঙ্গে মিশে অবিকৃত থাকার দরুন মাটিতে যে পচনশীল ব্যাকটেরিয়া থাকে তা বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাটিতে পচনশীল কাজে ব্যাঘাত ঘটে। এ ছাড়া পানি নিষ্কাষনেও পলিথিন চরম বাধাগ্রস্থ করে থাকে। পলিথিন হতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। যা ভূ-গর্ভস্থ পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করে পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ জীব ও বিচিত্রকে হুমকিতে ফেলে। যার ফলে মাটির নীচের জীব-বিচিত্র প্রানাশের হুমকিসহ মাটি তার উর্বরতা হারাচ্ছে এই ক্ষতিকর পলিথিন কারণে। একই সাথে দেখা গেছে, অনেক সময়ই শহরের গুরুত্বপূর্ন চলাচলের রাস্তার পাশে,স্থানীয় পাড়া-মহল্লা, অলিগলি, বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় পড়ে থাকা যে সকল ময়লা আবর্জনার স্তুপ দৃশ্যমান হচ্ছে সেই স্তুপের বেশির ভাগ আর্বজনাই হলো পলিথিন, আর বাকি অংশ কাগজ, বাচ্চাদের ব্যবহৃত প্যাম্পাস, গৃহস্থালির উৎশিস্ট ময়লা, প্লাস্টিকের বোতলসহ অন্যান্য বর্জ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১ নভেম্বর হতে সরকার নিষিদ্ধ পলিথিন/পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের ঘোষনা দিয়েছে। প্লাস্টিক দূষণরোধকল্পে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে ব্যবসায়ী, দোকান মালিক, বিক্রেতাসহ সর্ব সাধারনকে নিষিদ্ধ পলিথিন/পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগ পরিহার করতে বলা হয়েছে। সরকার কর্তৃক ঘোষিত এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় গত, ১ নভেম্বর হতে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদাহ, নড়াইল, মাগুরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলাতে জেলা/উপজেলা প্রশাসনের সমান্বয়ে নিষিদ্ধ পলিথিন/পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে এবং অভিযান চলমানও আছে। গত, ৩ নভেম্বর হতে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের ১৪ টি মোবাইল কোর্টের অভিযানে ৩৬ প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করে ৪৬ হাজার ৫’শ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই সাথে জব্দ করা হয়েছে ২ হাজার ১৬২ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন। অভিযানে ঝিনাইদাহ সদর একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা জরিমান ও ১৮০০ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। একই দিনে নগরীর দৌলতপুর বাজারের একটি প্রতিষ্ঠান হতে ১৮৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নিয়মিত অভিযান চলমান থাকলেও খুলনা নগরীতে এখনো চুপিসারে চলছে পলিথিনের ব্যবহার। নগরীর বিভিন্ন খুচরা সবজি, মাছ-মাংস, ফলের দোকানগুলোতে চুরিসারে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ এই পলিথিন। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে পলিথিন বিক্রি বন্ধ করলেও গোপনে সু-কৌশলে পলিথিনের বিক্রয় ও ব্যবহার অব্যহত রেখেছেন। এছাড়া খুলনার স্থানীয় এলাকার দোকানপাট গুলোতে বেকারীর খাদ্য সামগ্রী বিক্রিতে ক্ষতিকর এই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার করা হচ্ছে। খুলনার নাগরিক নেতা বলছেন, কেবলমাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব নয়। পলিথিন বন্ধে একদিকে যেমন জনগনকে সচেতন করে তুলতে হবে, অপরদিকে যেখানে পলিথিনের মূল উৎপাদন হচ্ছে, সেই সকল কারখানা বন্ধ করতে হবে। মূল জায়গা হতে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হলে সর্বত্রই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।
পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫’র তথ্যনুসারে, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা-নিষেধনুসারে সরকার, মহা-পরিচালকের পরামর্শে বা অন্য কোনভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যে কোনো প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যে কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তা হলে সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সমগ্র দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এইরুপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বানিজ্যিক উদ্দেশ্য পরিবহন বা বানিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যবহার সম্পূর্নভাবে বন্ধ করতে বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ঐ সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারিবে এবং উক্ত নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকবেন। উক্ত আদেশ অমান্য করলে উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। পরিবর্তী প্রতিটি অপরাধের জন্য অন্যূন ২ (দুই) বৎসর, অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারা দন্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লক্ষ টাকা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা ক্ষেত্রে অনধিক ১ (এক) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
চাকুরীজীবি ফারুক হোসেন জানান, আমি দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নভেম্বরের ১ তারিখ হতে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপর হতে আর পলিথিন ব্যবহার করি নাই, বিকল্প ব্যবহার করছি। কিন্তু, দুঃখ জনক আমার একার সচেতনতা দিয়ে কি পলিথিন বন্ধ সম্ভব? বাজার করতে গিয়ে দেখছি, বিক্রেতারা চুরিসারে ক্রেতাদের পলিথিনে মালামাল দিচ্ছে। এভাবে কি পলিথিন বন্ধ হবে? আমি মনে করি, যেখানে মূল পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে সেখান হতে সরকার যদি পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ গ্রহন করে তবে সর্বস্তরে পলিথিনের ব্যবহার আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
বাজার আসা ক্রেতা রুম্মান বলেন, ‘পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ তা জানি। পলিথিন ব্যবহারে ঝামেলা কম, যে কারণে মানুষ এ কারণে এটি ব্যবহার করে। কিন্তু গত ১ নভেম্বর হতে পলিথিন ব্যহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তাই সচেতন নাগরিক হিসাবে আমি ওই দিন হতেই পলিথিন পরিহারের সিধান্ত নিয়েছি। এখন প্রতিদিন বাজারের জন্য বাড়ী হতে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে আসি। পরিবেশের সুরক্ষা ফিরিয়ে আনতে সকলকে পলিথিন পরিহার করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
ব্যবসায়ী আবু সাইদ জানান, সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করার পর অনেকেই মধ্যেই সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই এখন পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে বিকল্প ব্যবহার করছে। তবে সম্পূর্নরুপে পলিথিন এখনো বন্ধ হয়নি। পলিথিন বন্ধ করতে হলে কেবলমাত্র দু’চার জন ব্যবসায়ীর বেচাবিক্রি বন্ধ করলেই হবে না, যেখান থেকে মূল পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে , সেখানই থেকেই পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পলিথিনের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যহত রাখতে হবে।
দৌলতপুর বাজার বণিক সমিতির সাঃ সম্পাদক নান্নু মোড়ল জানান, নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধের ঘোষনা দেওয়ার সাথে সাথে সমগ্র দৌলতপুর বাজারে মাইকিং করে পলিথিন ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবহার করা হতে বিরত থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এরপরও যারা এখনো বাজারে চুরিসারে পলিথিন ব্যবহার করছে তাদেরকে পুর্নরায় সচেতন করাসহ পলিথিন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহন করবো। আমরা আমাদের প্রতিটি ব্যবসায়ীকে পলিথিন বিক্রয় ও ব্যবহার হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিবো, তবে যেখান থেকে মূল পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে , সেখানই থেকেই পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করতে সর্বত্র পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।
এ ব্যাপারে সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাঃ সম্পাদক এড. কুদরত-ই খুদা জানান, পরিবেশকে ধ্বংসের হাত রক্ষা করতে হলে অবশ্যই ক্ষতিকর পলিথিন পরিহার করতে হবে। কেবলমাত্র ঘোষনা দিয়ে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব নয়। পলিথিন বন্ধের ব্যাপারে সত্যিকারি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হলে মূল কোথায় উৎপাদন হচ্ছে সব সকল কারখানা বন্ধ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ও এক্সিকিউটিভ ম্যাসিস্ট্রেট মো. আসিফুর রহমান জানান, গত, ১ নভেম্বর হতে অত্র দপ্তর নিষিদ্ধ পলিথিন/পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাতে জেলা/উপজেলা প্রশাসনের সাথে সমান্বয় করে অভিযান অব্যহত রেখেছে, যা চলমানও। ইতোমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। তথাপী, যারা এখনো নিষিদ্ধ পলিথিনের বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ ও বিতরণ করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।