শিল্প কলকারখানার কারণে চাপাতলায় পুরাতন জনপদ বিলুপ্তের পথে ঃ ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি

# কোম্পানীর শব্দ আর বায়ু দুষণে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ #
খলিলুর রহমান সুমন ঃ বাগেরহাট সদর থানার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চাপাতলা গ্রামের পূর্বপাড়ায় পুরাতন জনপদ এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে। টিকা গ্রুপের বিশাল কোম্পানীর (গ্রীন বোর্ড ফাইবার মিলস লিঃ) শব্দ দুষন, কৃষি জমি দখল, পুকুর, কবরখানা দখল আর দুর্গন্ধে ওই এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি চাপাতলা পূর্বপাড়া ইট বিছানো পথ দিয়ে হাটতে গেলেই কোম্পানীর দুর্গন্ধ নাকে আসে। এছাড়া পথ চলতে গিয়ে দেখা যায়, গাছের পাতার ওপর এক ধরণের কালচে আবারণ পড়েছে। ধুলার মত কাঠের গুড়া অঝর ধারায় পড়তে দেখা যায়। এসব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে এলাকাবাসী নানা ধরনের অসুখে ভূগছে বলে তারা জানান। পতিত সরকারের অন্যতম কর্ণধর শেখ হেলালের সহযোগিতায় এ কোম্পানী গড়ে উঠেছে বলে এলাকার লোকজন জানান। তার ভয়ে এ কোম্পানীর সকল অত্যাচার জুলুম এলাকাবাসী মুখ বুঝে সহ্য করে চলেছে। এখন তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানীর লোকজন ভোল পাল্টিয়েছে। ভুক্তভোগী চন্ডিচরণ দাস বলেন, ২০১৬ সালে এখানে গড়ে তোলা হয় কোম্পানী। সম্প্রতি এই কোম্পানীর সাইন বোর্ড ঝুলানো হয়েছে। এখানে কাঠের গুড়া দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে পারটেক্স বা উডটেক্স। এ কোম্পানীর উৎপাদিত পন্য রপ্তানী করা হয় বিদেশে। এ কোম্পানীর শব্দে রাতে-দিনে কখনই শান্তিতে ঘুমানোর যায় না। দুগর্ন্ধে বাড়িতে টেকা কস্টকর। গাছের পাতায় উড়ে পড়ছে এক ধরণের ঘুড়ি। যা গাছপালা নস্ট করে ফেলছে। এ কোম্পানী জমি ক্রয়নীতিমালা না মেনে দালালের সহযোগিতায় অল্প অল্প করে বাজার দরে জমি ক্রয় করছে। তাদের বাড়ির চারপাশে জমি বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের শুধু এক একর জমি বাকী আছে। তাও কেনার জন্য কোম্পানীর দালাল নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। এখানে ৭/৮টি পরিবারের মধ্যে তারা একটি পরিবার আছেন। বাকীরা সবাই চলে গেছে। তাদের জমি কোম্পানীর মালিক দালালের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কিনে নিয়েছে। এখানে চৈত্র্য-বৈশাখ মাসে কোম্পানীর ভিতর থেকে প্রচুর গুড়ি উড়ে আসে। এতে করে এলাকার বাসিন্দারা শ্বাস কস্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। গাছপালা মরে যাচ্ছে। রাতে কোম্পানীর শব্দে ঘুমানো কস্টকর। এতে করে তারা পরিবারের সবাই নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে বলে জানান আরেক সদস্য শ্যামাপদ দাস। তিনি জানান, তাদের মূল পেশা পান চাষ করা। তারা পান চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোম্পানীর কালচে রং যুক্ত গুড়া ওপর পড়ে গাছ ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। এ কোম্পানীর মালিক এলাকার বড় বড় চারটি পুকুর ঘিরে ফেলেছে। সময় সুযোগ মত তা ভরাট করে ফেলবে। তবে এলাকার যগিন্দ্রী পুকুর এখনও টিকে আছে। কোম্পানীর এত দুর্গন্ধ ভাত খাওয়া কস্টকর। যখন কোম্পানীর মেশিন চালু হয় তখন ভুমিকম্পের মত তাদের বাড়ি ঘর কাঁপতে থাকে। যুথিকা দাস বলেন, এখানে এখন দু’টি পরিবার বসবাস করছে। পুরাতন জনপদ বিলুপ্তের পথে। এখানে শুধু জমি কিনে ক্ষ্যান্ত হচ্ছে তা নয়, দালালরা বাড়ির পাশাপাশি কবরস্থানও কিনে নিয়ে এখানে কোম্পানীর স্থাপনা করছে। তার মধ্যে আনুমানিক দু’কাঠার মত এরিয়ার কেনা মোল্লার কবরস্থান (পারিবারিক) তা কিনে তার ওপর কোম্পানীর স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভৈরব নদীর ঘাটে শ্মশান ছিল তা দখল করে নিয়েছে। কোম্পানীর কারণে এ পরিবারটি অনেকটা জলাবদ্ধতায় শিকার হয়েছেন। যার জন্য তাদের পানের বরজ পানিতে নস্ট হয়েছে। বাগেরহাট সদর থানাধীন যাত্রাপুর ইউনিয়নের চাপাতলা গ্রামের পূর্বপাড়ায় গড়ে উঠেছে টিকাগ্রুপের এই বিশাল কোম্পানী। সীমা রাণী জানান, কোম্পানীর শব্দ দুষণে তারা আজ বদির হতে চলেছেন। জোরে কথা না বললে পরিবারের কেউই কানে শুনতে পান না। কোম্পানীর দালালরা এমনভাবে চাপ দিচ্ছে তাতে জমি না বেঁচে কোন উপায় নেই। লক্ষী রাণী নামের একজন গৃহিনী জানান, বিকাশ নামের জনৈক একজন দালাল কোম্পানীর হয়ে জমি বাজার দরে ক্রয় করে নেয়। পরে সে কোম্পানীকে দেয়। হরিপদ দাসের স্ত্রী লিলি দাস বলেন, জমিতে হাঁটুজল হতো। কোম্পানী কিনে নিয়ে তাদের যে টাকা দিয়েছে তাতে তিনি সন্তোষ্ট। তারা বলেন, এখানে সাত পুরুষের বসবাস। ৪/৫টি পরিবার ছাড়া সবাই জমি বিক্রি করছে। এ জন্য পুরাতন জনপদ আর এখানে থাকছে না। পুরাতন লোকালয়ের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা ছাড়তে কস্ট হলেও কোম্পানীর দালালের চাপাচাপিতে বাড়ি ও জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি বলে তারা জানান। বাগেরহাট জেলা পরিবেশ সুরক্ষা নাগরিক কমিটির সাঃ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান লিটন বলেন, এই কোম্পানী সৃষ্টির পর থেকে কোন সাইনবোর্ড ঝুলনোর প্রয়োজন মনে করেনি। গত ৫ আগস্টের পর এই কোম্পানীর বাগেরহাটের অভিভাবক পালিয়ে যাওয়ায় তারা সাইন বোর্ড ঝুলিয়েছেন। এত দিন ওইসব ক্ষমতাধরদের সহায়তায় এই এলাকার কৃষি, কবরস্থান, পুরাতন জনপদ সব কিছু ধ্বংস করেছে। এখন তারা ভোল পাল্টিয়ে নতুন অভিভাবক খুঁজছে। পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনার আহবায়ক নাগরিক নেতা এড. কুদরত ই খুদা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, এতবড় একটি কোম্পানীর নিয়মণীতির কোন বালাই নেই। কোম্পানীর শব্দে আর দুর্গন্ধে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। সম্প্রতি চাপাতলা পূর্বপাড়া ইট বিছানো পথ দিয়ে হাটতে গেলেই কোম্পানীর দুর্গন্ধ তারসহ একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নাকে আসে। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলার সময় দালালদের ঘুরতে দেখা যায়। এরা দরিদ্র এলাকাবাসীকে নানা প্রোলোভন আর ভয়ভীতি দেখিয়ে বাজার দরে জমি কিনে নিচ্ছে। কয়েকটি বড় পুকুর কিনে নিয়েছে। এখন ভরাট করার প্রস্তুতি নিয়েছে। কোম্পানীর ভিতর থেকে বাতাসে উড়ে আসছে এক ধরনের গুড়ি। যা গাছের পাতার ওপর পড়ে কালচে রং ধারণ করছে। এতে করে এলাকার গাছপালা নস্ট হচ্ছে। জনবসতি এলাকায় এ ধরণের কোম্পানী মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যারা এ কোম্পানীর নিকট জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না তারা খুবই চাপের মুখে রয়েছে বলে এলাকাবাসী তাদের নিকট অভিযোগ করেছে বলে জানান। এসব পুরাতন জনপদে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আইনগতভাবে ঠিক নয় বলে এই নাগরিক নেতা দাবি করেন। অবিলম্বে এ কোম্পানীর বেআইনী কর্মকান্ড বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, যাত্রাপুর ইউনিয়নের মধ্যে একটি সবুজ গাছপালা ঘেরা শান্ত গ্রামের নাম “চাপাতলা”। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদী। গ্রামের মধ্যে ইটের রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে চোখে পড়লো বড় বড় পুকুর। অসংখ্য হাস পুকুরগুলোর মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে। রাজহাঁসগুলো রাজসিক ঢংয়ে কক-কক শব্দে রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। সব মিলিয়ে অপরূপ দৃশ্যে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম। এই গ্রামে একটি পুকুরের নাম “সিড়ি পুকুর”। আয়তন এক একরের উপরে হবে। পুকুরে অধিকাংশ সময়ে লাল পদ্ম ফুটে থাকতো। পুকুরে “সান বাধানো” ঘাট ছিলো বলে এই পুকুরের নাম “সিড়িপুকুর”। গ্রামের লোকেরা বললো, ঐ পুকুরকে ঘিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ধর্মীয় পূজা এবং সাস্ত্রীয় আচার-আচরণ পালন করতেন। সেই পুকুরটি সম্প্রতি ভরাট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে কোন ভাবেই কৃষি জমির প্রকৃতি (শ্রেণী) বদল করা যাবে না। এটা বে-আইনি এবং আদালতে প্রতিকার পাওয়ার যোগ্য। তাই আমরা মনে করি, সরকার ঘোষিত শিল্পাঞ্চল ব্যতিত অপরিকল্পিত ভাবে যত্রতত্র কৃষিজমি নষ্ট করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখনই বন্ধ হওয়া উচিৎ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি তদন্ত করে যথাশিঘ্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা প্রয়োজন। তবে কোম্পানীর এক প্রতিনিধি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বাগেরহাট জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আসাদুর রহমান গত দু’ মাস আগে এখানে যোগদান করেছেন। তিনি এ কোম্পানীর ব্যাপারে কিছু জানেন না। অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। বিষয়টি তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখবেন বলে জানান। কোম্পানীর এডমিন আজমল হোসেন আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমাদের কোম্পানীর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে। আমরা সব আইন মেনে এখানে কোম্পানী চালু করেছি। এখনে ২শত জনের মত শ্রমিক এখানে কাজ করে। এখানে বোর্ড উৎপাদন করা হয়। শব্দ দুষণ বা কম্পনের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেন।