স্থানীয় সংবাদ

বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী ভীড় বাড়ছে খুলনা শহরে ঃ নারী-শিশুরা ভূগছে পুষ্টিহীনতায়

# নগরীতে গড়ে উঠেছে ১৯১০টি বস্তি #

খলিলুর রহমান সুমন ঃ অপরিকল্পিতভাবে নেয়া মেগা প্রকল্প এলাকার বাস্তÍুচ্যুত জনগোষ্ঠীর ভীড় বাড়ছে খুলনা শহরে। গত কয়েক বছরে এদের আগমনের হার বেড়েছে আশংকাজনক হারে। এরা আশ্রয় নিয়েছে খুলনা নগরীর বিভিন্ন বস্তিতে। অর্থ সংকটে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে পরিবারের নারী ও শিশুরা ভূগছেন পুষ্টিহীনতায়। আর যারা এলাকায় রয়েছেন তাদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। বাস্তÍুচ্যুত এসব জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
তানিয়া আক্তার। বয়স তার ২৬/২৭ বছর হবে। পেশায় গৃহিনী। দু’ সন্তানের জননী তানিয়া অভাব অনাটনে খুলনায় ছুটে এসেছেন। বড় মেয়ে বৃষ্টি। পড়ে ষষ্ঠ শ্রেনীতে। স্বামী আঃ রহমান দিন মজুর। খুলনার একটি বস্তিতে মাত্র অল্প টাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে নগরীতে দিন মজুর খাটেন আঃ রহমান। যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার খরচ চলে না। পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহ করা কঠিন ব্যাপার তার জন্য। তিনি বাগেরহাট গৌরম্ভা ইউনিয়নের কৈগড়দশকাঠি গ্রামের চরে বাস করতেন। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে। তারা দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ ধরে ওইখানে বসবাস করছেন। সরকার তাদের এক বিঘা আট কাঠা করে জমি দেয় ওই চরে। ওই একই সময় প্রায় সাতশত পরিবার একইভাবে চরে বসবাস শুরু করে। তাদের অধিকাংশই সরকারের দেয়া জমি পান। সেখানে মাছ ও ধান চাষ করা হতো। ফল ফলাদি গাছও ছিল প্রয়োজন মত। কোন অভাবই ছিল না তাদের পরিবারে। এসব পরিবার মূলত কৃষি ও জেলে পেশার সাথে জড়িত ছিল। তাদের ঘেরে চিংড়ি, পাইশ্যা, পাবদা মাছের চাষ হতো। যার দাম বাজারে অনেক। জমিতে যে ধান হতো তাতে বছর চলে যেত। চাউল কিনতে হতো না। ঘেরে যে মাছ চাষ হতো তা খেয়ে আরো বিক্রি করে অন্যান্য চাহিদা মেটানো হতো। কিন্তু ওই এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পর সরকার তাদের জমি ছেড়ে দিতে বলে। ২০১৫-১৬ সাল নাগাদ ঘোষণার এক দিনের মাথায় তাদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। জামা-কাপড় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া তারা আর কিছুই নিতে পারেননি। তড়িঘড়ি করে তারা সবাই পশুর নদীর পাড়ে বাঁশ খুটি আর পলিথিন দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। সেখানে ছয় মাস থাকার পর আবারও তাদের উচ্ছেদ করা হয়। তারা বাধ্য হয়ে নদীর পাড় ছেড়ে পাশ্ববর্তী সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেন। কিছু পরিবার লিটুর চরে গিয়ে ঘর তৈরী করে বসবাস শুরু করেন। বাকীরা সাইক্লোন সেন্টার ছেড়ে তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অস্থায়ীভাবে ঘর নির্মাণ করে বসাবাস শুরু করেন। পরে তিনি খুলনায় পাড়ি জমান। একই সাথে পাড়ি জমায় ওই এলাকার বাস্তÍুচ্যুত ৪০-৪৫টি পরিবার। চলতি বছরের প্রথম দিকে ঘর পাওয়ার আশ্বাসে খুলনা থেকে ওই এলাকায় ফিরে যান। ঘরও পান। কিন্তু মাত্র দু’শতক জমির উপর ঘর করা। ওইখানে শাখ সবজি, গারু ছাগল হাস মুরগী পালন করার কোন সুযোগ নেই। বর্তমানে তারা পশুর নদীতে রেনু পোনা ধরছেন। তাও আবার নৌ পুলিশকে মাসোহারা দিতে হয় প্রতিদিন। তিনি বলেন, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থানীয় মানুষদের কাজে নেয় না। যার জন্য তারা মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করছেন। এলাকার ১২ আনা মানুষ বেকার জীবন যাপন করছে। বাকী পরিবারের সদস্যরা অর্থ সংকটে কাজের সন্ধানে খুলনা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে কোনভাবে বসাবাস করছেন। এখানে দিন মজুর হিসেবে কাজ করছেন। যে টাকা আয় করছেন তা দিয়ে ঘর ভাড়া আর সংসার এক সাথে চালানো কস্ট কর হয়ে পড়ছে। এ টাকা দিয়ে কোন রকম মোটা চাল আর মোটা কাপড় পড়ে দিন পার করছেন তারা। পুষ্টিকর খাবার যোগাড় করা যেন তাদের ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় এসব পরিবারে ছিল ঘরে চাল আর ঘেরের মাছ, ছিল না কোন অভাব। আজ সেই মানুষগুলো বাস্তÍুচ্যুত হয়ে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন। রূপসার চানমারী বস্তিতে বাস করেন শরিফা বেগম। নগরীর অন্য বস্তিতে বাস করেন আবেদ শেখ। তারা সবাই বাস্তÍুচ্যুত। এক সময় তাদের চোখে মুখে ছিল সোনালী স্বপ্ন। আর এখন তাদের চোখে মুখে দুঃস্বপ্নের ছাপ। খাবারের অভাবে তারা পুষ্টিহীনতায় ভূগছেন। সন্তানদের লেখা-পড়া আর সুচিকিৎসা যেন আর কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ সুচিকিৎসার অভাবে দুখে দুখে মরছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা রাফিজা বেগম। তিনি দু’ সন্তানের জননী। তার স্বামী এরশাদ আলী গাজী এখন বেকার। ছেলে সারাফাত গাজী (১৭) দিন মজুর। তিনি নিজে গৃহীনি। তিনি বলেন, তারা খুবই সমস্যায় আছেন। আগে তারা যেখানে বসবাস করতেন। ওখান থেকে তাদের বের করে দেয়া হয়। তখন তারা পশুর নদীর পাড়ে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকেও তাদের উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে তারা পাশ্ববর্তী সাইক্লোন সেন্টারে অবস্থান করছেন। এখন তিনি সরকারের দেয়া ঘরে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা গ্রহণে কোন সুযোগ নেই। অসুস্থ্য হয়ে পড়লে পশুর নদী পার হয়ে চালনায় যেতে হয়। খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে খুলনা মেডেকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়। নেই কোন স্কুল-কলেজ। ফলে ছেলে মেয়েরা হয়ে পড়ছে মুর্খ। একটি মাত্র প্রাইমারী স্কুল রয়েছে। যার নাম কৈগড়দশকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলে টিফিন দেয় না। উপ-বৃত্তির টাকা পাঁচজন পায় তো দু’জন পায় না। এ জন্য এসব দরিদ্র শিশুরা স্কুল মুখী না হয়ে পোনা আহরণে পরিবারের অভিভাবকের সাথে ছুটে যায়। কর্ম না থাকার কারণে তারা বেকার জীবন যাপন করছেন। তার স্বামী এখন মহিষ পালন করে রাখালের কাজ করছেন। যা আসে তাতে কোন রকম সংসার চলে। তারা এক সাথে ৩/৪শত পরিবার এক সাথে সাইক্লোন সেন্টারে ছিলেন। এর বেশীর ভাগই খুলনার বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে বসবাস করছে। এছাড়া কিছু মানুষকে সরকার ঘর করে দিয়েছে। তবে সেখানে গৃহীত পালিত পশু পালন ও শাখ সবজি চাষের কোন সুবিধা নেই। আগে তাদের একবিঘা আট কাঠা জমি ছিল। যাতে তারা চাষাবাদ ও মাছ চাষ করে জীবন নির্বাহ করতেন। এখন তা বালু দিয়ে ভরাট করে দেয়া হয়েছে। তাই তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। ওইখানে তাদের খাওয়ার পানির বড়ই সংকট। একটি মাত্র টিউবওয়েল রয়েছে। তা প্রায় অকেজো অবস্থায় থাকে। পানি দিয়েই পানি উঠাতে হয়। শুধু তারা নয়, এ জনগোষ্ঠীর সবাই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি অবস্থান করছেন বলে জানান। একই কথা বলেন ওই একই জায়গার বাস্তÍুচ্যুত মানুষ মুর্শিদা বেগম। তিনি বলেন, অসুস্থ্য মানুষের চালনা হাসপাতালই হচ্ছে একমাত্র চিকিৎসার ভরসার স্থল। তার ওপর নৌকার মাঝির দয়াও রয়েছে তার সাথে মিশে। তিনি দয়া না করলে নৌকা দিয়ে পশুর নদী পার হয়ে চালনা আসা যায় না। শত সংকটের মাঝে এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখন তারা অনেকটা বেকার জীবন যাপন করছেন। ছেলে মুরছালিন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। পশুর নদীতে রেনু পোনা ধরে জীবন যাপন করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে হাজার টাকা আয় হয়। এ জন্য প্রতিদিন নৌ পুলিশকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। তবে যারা ঘাট নিয়ে রেনু পোনা আহরণ করেন তারা পুলিশকে বেশী করে টাকা দিয়ে থাকেন। এসব রেনু চালনার ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে এখানকার বাসিন্দারা ভাল নেই বলে তিনি জানান। কেসিসির চীফ প্লানিং অফিসার আবির উল জব্বার বলেন, ২০১৭ সালে খুলনা নগরীতে ইউএনডিপি বস্তি নিয়ে জরিপ করে। তাদের হিসেব মতে, নগরীতে ছোট-বড় ১৯১০টি বস্তি রয়েছে। তবে ওই সংস্থা এগুলোকে বস্তি সংজ্ঞা না দিয়ে বলেছে, এগুলো পুওর সেটেলমেন্ট। অর্থ্যৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাসের স্থান। এসব বস্তিতে চার থেকে সাড়ে চার লাখ জনগোষ্ঠী বসবাস করে। যাদের জীবন মান খুবই খারাপ। এদের মধ্যে ৬০ ভাগ বসবাস করে সরকারি বস্তিতে। বাকীরা ব্যক্তি মালিকানা বস্তিতে বসবাস করে। এরা অধিকাংশই জলবায়ু উদ্ধবাস্তু। কেসিসির টাউন ফেডারেশনের নেতা রোকেয়া রহমান জানান, এসব বস্তিবাসী অধিকাংশই বাস্তÍুচ্যুত। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, আম্পান, নদী ভাঙ্গন, অপরিকল্পিত বড় বড় উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ নানা দুর্যোগে এলাকা ছেড়ে খুলনা নগরীর বস্তিতে বসবাস শুরু করে। আর ফিরে যায়নি। এদের জীবনমান উন্নয়নে কেসিসি কাজ করছে বলে তিনি জানান। পরিবেশবাদী সংগঠন আইআরভির প্রধান নির্বাহী মেরিনা যুথি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায়ে দেশের দক্ষিণ পশ্চমাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর উপর। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘর্ণীঝড়, জলোচ্ছাস, নদী ভাঙ্গন এর ন্যায়, দুর্যোগের প্রবনতা বাড়ছে। ফলে জীবন জীবীকার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যে কারণে পেশা হারিয়ে বন্ডেড লেবার হয়ে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। এর ফলে নারীদের অবৈতনিক কাজ বাড়ছে। একসময় দারিদ্রের কষাঘাতে অন্য কোন এলাকা বা দেশে স্থান্তরিত হচ্ছে। ফলে তারা হারাচ্ছে তাদের দীর্ঘ দিনের সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও চর্চা। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে উন্নয়নের নামে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ও কৃষি জমিকে রুপান্তর করে শিল্প কলকারখানা। তাই উন্নয়নের নামে এসব কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে এবং স্থানীয় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ও নবায়ন যুক্ত জ্বালানিভিত্তিক কর্মস্ংস্থানের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নারীদের জলবায়ু সহনশীল কর্মকান্ডে নারীদের সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ খুলনার আহবায়ক এড. কুদরত ই খুদা বলেন, এটা আমাদের জন্য র্দুভাগ্যজনক। দেশে ল্যান্ড জোন না থাকার সুযোগে সুবিধাভোগীরা অপরিকল্পিতভাবে শিল্প কারখানা গড়ে তুলছে। এ সময় ওই এলাকার মানুষ উচ্ছেদ হচ্ছে। এদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী এসব অধিবাসীদের বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। অপরিকল্পিত শিল্প কল কারখানা যারা গড়ে তুলছেন তারা এসব আইন মানতে নারাজ। এদের কারনে বাস্তুচ্যূত মানুষগুলো নগরীর বস্তিতে এসে বসবাস শুরু করে। অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকে আর্থিক সংকটের কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এসব থেকে বাঁচতে হলে দেশে ল্যান্ড জোন করা খুবই জরুরী বলে মন্তব্য করেন এই নাগরিক নেতা।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button