# খুলনায় শনাক্ত ৩০ : মৃত্যু ৭ #
# সমকামী-যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বেশি
# অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালনে এইডসে ঝুঁকিতে : খুলনায় শনাক্ত ৩
কামরুল হোসেন মনি ঃ খুলনায় গত এক বছরে নতুন করে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল এআরটি সেন্টার থেকে ১ হাজার ৫৪৭ জনের রক্ত পরীক্ষার মধ্যমে এইচআইভি/এইডস শনাক্ত হয়েছে ৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ শনাক্ত ৫৯ জন এবং মহিলা রয়েছে ২৪ জন। এ সময়ে মরণব্যাধি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। শনাক্তের মধ্যে শিশু রয়েছে ৩ জন। এই ভাইরাসে নতুন করে সংক্রমিতদের মধ্যে সমকামী, যৌন কর্মী ও অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন থেকে রক্তগ্রহীতা ব্যক্তিরা বেশি রয়েছে। এর আগের বছর ওই সেন্টার থেকে শনাক্ত হয়েছির ৭১ জন। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে খুলনায় আজ পালিত হবে বিশ্ব এইডস দিবস। এবার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘অধিকার নিশ্চিত হলে, এইচ্আইভি/এইডস যাবে চলে’। দিবসটি উপলক্ষে খুলনার সিভিল সার্জনের উদ্যোগে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে এইডস প্রতিরোধ ও সচেতনতার লক্ষে দুইদিন ব্যাপী ক্যাম্পিং অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে দূষিত রক্তের কেনাবেচার ফলে দিনি দিন হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। সুস্থতার আশায় ব্লাড ব্যাংক থেকে কেনা রক্তে রোগীরা বহণ করে নিয়ে যাচ্ছেন মরণব্যাধি মারাত্মক সব ভাইরাস। রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ রোগজীবাণু। বাড়ছে মরণব্যাধী এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞদের মতে রক্ত পরিসঞ্চালনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে প্রসুতি মা, নবজাতক ও থেলাসামিয়া রোগীরা। তাদের মতে, পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা রক্তে মিলছে মারণব্যাধির সব ভাইরাস। এসবের মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইচআইভি (এইডস), ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এনিমিয়াসহ নানা রোগের জীবাণু। বিদ্যমান অবস্থায় রোগীর পক্ষ থেকে ব্যাগ কিনে দেয়ার পর রক্ত পরিসঞ্চালন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অত্যাবশকীয় পাঁচটি পরীক্ষা ছাড়াই রোগীর দেহে রক্ত দেয়া হচ্ছে। যার কারণে ওই সব প্রাণঘাতী রোগে রক্তগ্রহীতা আক্রান্ত হচ্ছেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের এআরটি ফোকাল পার্সন ডা: দীপ কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব বাচ্চা এইচআইভি পজিটিভ তারা জন্মগতভাবে এ রোগ পেয়েছে। আর তরুণদের মধ্যে একটি গ্রুপ সমকামী। এদের অনেকেরই ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের ইতিহাস থাকে। এরা যখন আমাদের কাছে আসে তখন তারা নিজেরাই হ্যাবিচুয়াল সমকামী। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচিত হচ্ছে, পার্টনার খুঁজছে। এতে একেবারে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করছে। অনেকে সংক্রমিত হচ্ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের সরকারি হাসপাতালে শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং সমকামীদের মধ্যে এইচআইভি-এইডসের চিকিৎসা নিশ্চিত করা; এইচআইভি এইডস আক্রাস্ত জনগোষ্ঠী নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা ও বৈষম্য রয়েছে তা দূর করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
খুমেক হাসপাতালে এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম এডমিনিস্ট্রেটর দিবেশ ওঝা বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪৭ জনের শরীরের রক্ত পরীক্ষার মধ্যমে খুলনা বিভাগসহ অন্য জেলায় মিলে মোট ৮৩ জনের এইচআইভি/এইডস পজিটিভ পাওয়া যায়। এর মধ্যে পুরুষ ৫৯ জন ও মহিলা রয়েছে ২৪ জন। এর মধ্যে ৩ জন শিশুও রয়েছে। এই শনাক্তের মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, শরিয়তপুর ও বরিশালে জেলার বাসিন্দারা রয়েছেন। তার দেওয়া তথ্য মতে, এইচআইভ/এইডস পজিটিভ পাওয়ার মধ্যে খুলনা ৩০ জন ( পু: ২৪, ম: ৬ জন), বাগেরহাটে ১৪ জন ( পু: ৯ জন, ম: ৫ জন), গোপালগঞ্জে দুই জন (পুরুষ -২), যশোরে ১০ জন ( পুরুষ- ৭, মহিলা-৩), ঝিনাইদহে দুই জন ( পুরুষ -২), নড়াইলে ৯ জন ( পুরুষ -৭, মহিলা-২), পিরোজপুরে ৪ জন ( পুরুষ-৩, মহিলা-১), মাগুরায় একজন মহিলা, পটুয়াখালীতে একজন মহিলা, শরিয়াতপুর একজন পুরুষ এবং বরিশালে একজন পুরুষ এইচআইভি/এইডস পজিটিভ পাওয়া গেছে। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে মোট ২২ জনের। এর মধ্যে পুরুষ আছে ১৬ জন এবং মহিলা আছে ৬ জন। মারা যাওয়ার মধ্যে খুলনায় ৭ জন ( পুরুষ -৭), বাগেরহাটে ৬ জন, সাতক্ষীরায় ৩ জন, যশোরে ২ জন, পিরোজপুরে ১ জন, গোপালগঞ্জে ১ জন, নড়াইলে ১ জন এবং বরগুনায় একজন মারা যায়। শনাক্তদের মধ্যে সমকামীতা, সেক্স ওয়ার্কাকার, অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চাল থেকে রক্তগ্রহীতা ব্যক্তি ও থেলাসেমিয়া রোগীরা রয়েছে। এর মধ্যে অনিরাপদ সেক্সের মাধ্যমে ব্যক্তির সংখ্যা রয়েছে ৫৪ জন। এর মধ্যে সমকামীতা ও পুরুষ-মহিলা সেক্স ওয়ার্কার ব্যক্তিরা আছে ৩৬ জন। এর মধ্যে সমকামীতা ব্যক্তিরা আছে ১৬ জন। এছাড়া অনিরাপদ রক্ত গ্রহীতা রয়েছে ১০ জন। যারা এইচআইভি পজিটিভ। এর মধ্যে ( পুরুষ ১ জন এবং মহিলা রয়েছে ৯ জন)। সনাক্তের মধ্যে খুলনায় ৩ জন, বাগেরহাটে ৩ জন, যশোরে ১ জন, পটুয়াখালী ১ জন, পিরোজপুরে ১ জন এবং সাতক্ষীরায় ১ জন রয়েছে। অনিরাপদ রক্ত যে সব প্রতিষ্ঠান বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে এর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোরে একটি ডায়গণস্টিক সেন্টারের নাম উঠে আসে। যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের হিস্ট্রোরী অনুযায়ী ওই সব জায়গা থেকে তাদের প্রয়োজনে রক্ত গ্রহণ করেন। এদের কাছ অতিজরুরি ভুক্তভোগী থেলাসেমিয়া রোগী ও সিজারিয়ান রোগীরা রক্ত নেয়ার পর এইচআইভি পজিটিভ সনাক্ত হয়েছে।
খুমেক হাসপাতালের এআরটি সূত্র মতে, এ বছর নতুন করে মোট ৩০ জন রেফার্ড করা রোগী খুমেক হাসটপাতালে এআরটি থেকে সেবা নিচ্ছেন। এর মধ্যে আহসানিয়া মিশন থেকে ২২ জন, ঢাকা যক্ষা সংক্রামক হাসপাতাল থেকে ৪ জন, ব্এিসএমএমইউ থেকে ২ জন. চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ১ জন এবং আশার আলো এনজিও থেকে ১ জন আসছে। সে হিসেবে গত এক বছরে নতুন করে আইডিধারী এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া গেছে ১১৩ জন। ২১০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত খুমেক হাসপাতালে এআরটি সেন্টার থেকে মোট আইডিধারী রোগীর সংখ্যা রয়েছে ৭৪১ জন। এর মধ্যে নিয়মিত রোগীর সংখ্যা আছে ৪৩২ জন। মৃত রোগী সংখ্যা ৯৬ জন
এ পর্যন্ত এআরটি থেকে মোট রোগীকে রেফার্ড করা হয়েছে ১৬৩ জন।
জানা গেছে, রক্ত সঞ্চালনে মানা হচ্ছে না সরকারি বিধি নিষেধ। একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে রক্ত দিতে নির্ধারিত বাধ্যতামূলক ৫টি পরীক্ষাও করানো হচ্ছে না। মাত্র দুটি পরীক্ষা করেই নেওয়া হচ্ছে রক্ত। রোগী ও তার স্বজন, রক্তদাতা, হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের অসচেতনায় উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে রক্ত গ্রহীতার জীবন। বিভিন্ন রোগের অপারেশন, গর্ভকালীন অস্ত্রোপচার, দূর্ঘটনা, রক্তশূণ্যতা ও থ্যালাসেমিয়া রোগিরা সাধারণত রক্ত গ্রহণ করেন। রক্ত সঞ্চালনা আইন অমান্য করলে জরিমানা ও সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের অধিকাংশই এই আইনটি সম্পর্কে অবগত নন। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন-২০০২ বাস্তবায়নে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের তৎপরতা এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রান দিবে এমনটি ভাবনা চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে সনাক্ত হয় ৬৫, ২০২৩ সালে ৭১ জন এবং ২০২৪ সালে ৮৩ জন।